দুর্বল সংগঠন ও নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত নেতাকর্মী

দুর্বল সংগঠন ও নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত নেতাকর্মীছবি-সমকাল

টানা ১৫ বছরে তিনটি নির্বাচনের আগেই দাবি আদায়ের আন্দোলন ‘ব্যর্থ’ হওয়ায় চিন্তিত বিএনপি নেতাকর্মী। সবার মনে একটাই প্রশ্ন– সরকার কি এবারও দমনপীড়নের মাধ্যমে পাঁচ বছর টিকে যাবে? নাকি বৈশ্বিক চাপ, অর্থনৈতিক সংকট এবং আন্দোলন মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগে বাধ্য হবে– এমন হিসাবনিকাশ ও আশা-নিরাশার দোলাচলের মধ্য দিয়ে সময় যাচ্ছে বিরোধী নেতাকর্মীর। একই সঙ্গে দলের ভেতরের সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের দুর্বলতা নিয়েও চলছে আত্মসমালোচনা। ফের ঘুরে দাঁড়াতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ব্যর্থ ও নিষ্ক্রিয়দের বাদ দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের মাধ্যমে নেতৃত্ব পুনর্গঠনের তাগিদ দিয়েছেন তারা। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে আলাপ করে এমন অভিমত পাওয়া গেছে।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদের শূন্য পদগুলো দ্রুত পূরণেরও তাগিদ দিয়েছেন নেতাকর্মী। একই সঙ্গে দলের ভেতর সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার ও ভোটের মাধ্যমে ‘ঢাউস কমিটি’র বদলে ছোট ও সময়োপযোগী কমিটি গঠন করার যুক্তি দিয়েছেন। নিষ্ক্রিয়দের বাদ, বয়স্ক ও অসুস্থদের স্থায়ী কমিটি থেকে উপদেষ্টা (উপদেষ্টাদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা তুলে ‘সম্মানীত উপদেষ্টা’ করা) করার পাশাপাশি সক্রিয় ও পোড় খাওয়া যোগ্যদের মূল্যায়নের ওপর জোর দিয়েছেন মাঠকর্মীরা। দলে পদায়নে সিনিয়রিটি বজায় রাখার ব্যাপারেও গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, অতীতে এটি লঙ্ঘিত হওয়ায় অনেকে মনঃকষ্টে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।

‘দলের চেইন অব কমান্ড’ বিঘ্নিত হওয়ার উদাহরণ দিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে সরাসরি শীর্ষ নেতৃত্বের যোগাযোগ না করার পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ও মাঠের নেতারা।

একই কারণে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক উইংকে দুর্বল আখ্যায়িত করে শক্তিশালীকরণ ও বৈশ্বিক রাজনীতির গভীরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দলের নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে সবার আগে গ্রেপ্তারকৃত দলের মহাসচিবসহ ২৭ হাজার নেতাকর্মীকে কারামুক্ত করার বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে দলীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নেতাকর্মী।

২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে টানা হরতাল-অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট বর্জন করে এখনও আন্দোলনে রয়েছে দলটি। ২০১৬ সালের মার্চে বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল হয়। সেখানে খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিব নির্বাচিত হন। এর পর দলটির সম্মেলন হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়া এবং নিষ্ক্রিয় ও বেশ কয়েকজনের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য রয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীকে কারামুক্ত করার পর জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দ্রুত দলের গুরুত্বপূর্ণ শূন্য পদগুলো পূরণের দাবি দলের ভেতর জোরদার হচ্ছে। অবশ্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হলে বিএনপি হাইকমান্ড কাউন্সিল বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান গতকাল সমকালকে বলেন, বিএনপির সংগঠনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক দলের নিয়মিত কর্মকাণ্ডেরই অংশবিশেষ। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিগত দেড় দশক ধরে বর্তমান একদলীয় সরকার ক্রমাগতভাবে ভিন্নমতকে বাধাগ্রস্ত করে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রমকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। সবাই দেখেছে, কীভাবে আমাদের বিগত কাউন্সিলের আগের মধ্যরাত পর্যন্ত সভাস্থল অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, আমাদের জেলা কাউন্সিলগুলো যেখানেই করার চেষ্টা হয়েছে, সেখানেই আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের যোগসাজশে প্রকাশ্যে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। কাজেই সংগঠনের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলতে দেওয়া হয়নি– এটা সর্বজনবিদিত। ফলে কিছুটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। এ জন্য দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই পরিবেশে সব রাজনৈতিক দলেরই সাংগঠনিক কার্যক্রম নিশ্চিত হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ্‌ গতকাল সমকালকে বলেন, দীর্ঘদিন সরকারি দলের নানা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া বিএনপির সাংগঠনিক কিছুটা দুর্বলতা আছে– এটা সত্য। দলের নেতৃত্বের পুনর্গঠন দরকার। যারা অসুস্থ, তাদের হঠাৎ সরিয়ে দিলে আবেগ তৈরি হতে পারে। তবে শূন্য পদগুলো দ্রুত পূরণ করা উচিত। একই সঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপিকে কালো পতাকা মিছিল করতে দেয়নি সরকার। দেশে গণতন্ত্র থাকলে এটা করত না। এভাবে চলতে থাকলে সুদূরপ্রসারী ফলাফল ভোগ করতে হবে। ধর্মীয় ও উগ্রপন্থিরা সুযোগ নিতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বিরোধী দল স্বাভাবিক রাজনীতি করতে না পারলে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করাও কঠিন বলে মনে করেন তিনি।

স্থায়ী কমিটির ১৯টি পদের মধ্যে ৫টি শূন্য, ৪ জন অসুস্থতায় নিষ্ক্রিয়

বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারম্যান, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য হবেন ১৯ জন। ২০১৬ সালে জাতীয় কাউন্সিলে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে আরও দু’জনকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়। সে ক্ষেত্রে শুরু থেকেই একটি পদ শূন্য রয়েছে। বর্তমানে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হয়ে শর্তসাপেক্ষে জামিনে মুক্ত রয়েছেন। শর্ত ও অসুস্থতার কারণে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে নেই তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রয়েছেন লন্ডনে। সেখান থেকে ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে দল পরিচালনা করছেন। এর বাইরে স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ এবং এম কে আনোয়ারের মৃত্যুতে চারটি পদ শূন্য হয়ে পড়ে। বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থতার কারণে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়।

মামলা ও সাজাজনিত কারণে দু’জন বিদেশে। এদের মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলার আইনি জটিলতায় ভারতের শিলংয়ে রয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। অন্যদিকে কারাগারে রয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। গ্রেপ্তার এড়াতে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে জামিন নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এর বাইরে সক্রিয় রয়েছেন ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমান।

এ পরিস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বিদেশে থাকা দু’জন নেতা ভার্চুয়ালি বৈঠকে যোগ দেন। শুরু থেকেই একটি, মৃত্যুজনিত কারণে চারটি ও অসুস্থতার কারণে চারটি পদ কার্যত শূন্য। এসব প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ানের মৃত্যুতে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভুলত্রুটির শঙ্কা করছেন দলটির নেতাকর্মী।

দলীয় পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী সমকালকে জানান, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করা প্রয়োজন। রোজার আগেই দলের স্থায়ী কমিটিতে ‘চমক’ দেখতে চান তারা। বিশেষ করে দলীয় অভিজ্ঞ ও ত্যাগী নেতাদের পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব, যাদের সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তাদের মধ্য থেকে শূন্য পদগুলো পূরণ করা উচিত, যারা নীতিনির্ধারণী ফোরামে বর্তমানের রাজনৈতিক সংকট, বৈশ্বিক রাজনীতির মেরূকরণ ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দলের করণীয় ব্যাপারে সময়োপযোগী ভূমিকা রাখতে পারেন। যেমনটি করেছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

একই সঙ্গে তারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীতে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বেশ কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ও ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের মধ্য থেকেও যোগ্য ও পোড় খাওয়া কয়েকজনকে সদস্য করা যেতে পারে। এ ছাড়া বর্তমানে যারা অসুস্থ হয়ে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন, তাদের উপদেষ্টা পরিষদে সম্মানজনক পদ দিয়ে আমৃত্যু রাখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদের পদমর্যাদা ভাইস চেয়ারম্যানের সমমান না করে বিশেষ বিবেচনায় আলংকারিক পদ হিসেবে ‘সম্মানীয় উপদেষ্টা’ করা যেতে পারে। কিন্তু বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হওয়ায় তারা দলের ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কৌশল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতে না পারলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য জানান, দলের অনেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য রয়েছেন, যারা জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার যোগ্য। তার পরও দীর্ঘদিন ধরে পদ শূন্য রাখার কোনো মানে হয় না। এটি দলের চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলেই সদস্য করে নিতে পারেন। একই সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদ ও সম্পাদকীয় পদেও বেশ কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা ও সক্রিয় নেতা রয়েছেন, যারা ভাইস চেয়ারম্যান পদের যোগ্য।

ভাইস চেয়ারম্যান ৩৭ জনের মধ্যে শূন্য ১৫ ও নিষ্ক্রিয় ৭

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও অনেক শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুবরণ, চারজনের পদত্যাগ ও একজন বহিষ্কার, বিদেশে দু’জন পলাতক, একজন অসুস্থ, একজন নিষ্ক্রিয় এবং কারাগারে রয়েছেন তিনজন। ফলে ৩৭ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে ১৫টি পদ শূন্য এবং ৭টি পদ নিষ্ক্রিয় রয়েছে। আর সক্রিয় রয়েছেন মাত্র ১৫ জন।

মৃত্যুবরণকারী ১০ জন হলেন– বিচারপতি টিএইচ খান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাদেক হোসেন খোকা, অধ্যাপক এম এ মান্নান, আবদুল মান্নান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান ও ব্যারিস্টার আমিনুল হক।

পদত্যাগকারী চারজন হলেন– এম মোর্শেদ খান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম, আলহাজ মোসাদ্দেক আলী ফালু ও ইনাম আহমদ চৌধুরী। বহিষ্কৃত হলেন– শওকত মাহমুদ, বিদেশে পলাতক কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও গিয়াস কাদের চৌধুরী। অসুস্থ রয়েছেন রাবেয়া চৌধুরী ও নিষ্ক্রিয় রয়েছেন মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ এবং কারাগারে রয়েছেন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম পিন্টু (সাজাপ্রাপ্ত) ও শামসুজ্জামান দুদু।

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে একই অবস্থা

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের ৮২টি পদের মধ্যে ২২টি শূন্য রয়েছে। মৃত্যুবরণ, পদত্যাগ ও বহিষ্কারের কারণে এসব পদ শূন্য হয়। তিনজন অসুস্থ ও তিনজন জেলে। একজন বহিষ্কার ও দু’জন দলত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া ৫ শতাধিক ঢাউস বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর বেশ কয়েকটি পদ আগে থেকেই ফাঁকা, আবার কয়েকজন মারা গেছেন। নির্বাহী কমিটির সদস্যের মধ্যে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন।

ছোট কার্যকর কমিটি গঠনের দাবি

২০১৬ সালে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলেই প্রথম পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা ও সদস্যকে নিয়ে জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। শুধু নির্বাহী কমিটি নয়; জাতীয় স্থায়ী কমিটি এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ বিশাল আকৃতির করা হয়েছে। একই অবস্থা বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কমিটিগুলোতেও।

নাম প্রকাশ না করে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানান, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির কেন্দ্রীয় পাঁচ শতাধিক নেতার বিশাল কমিটির অধিকাংশ নেতাকে মাঠে দেখা যায়নি। যারা মিছিল করেছেন, তারা ছোট পদের, তৃণমূল পদের নেতাকর্মী এবং পদবিহীন সমর্থক। জানা গেছে, ২৭ হাজার নেতাকর্মী যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, কয়েকজন কেন্দ্রীয় হেভিওয়েট নেতা ছাড়া প্রায় সবাই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী।

বিএনপির সম্পাদকীয় পদের একজন নেতা আক্ষেপ করে জানান, কেন্দ্রীয় নেতারা হবেন অনেকটা ‘তারকা’র মতো খ্যাতি ও জনপ্রিয় পরিচিত মুখ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কমিটির বিপরীতে বিএনপির কমিটি হয়েছে পাঁচ-ছয় গুণ। ফলে আওয়ামী লীগ ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি হওয়ায় ঘন ঘন যে কোনো ছোট জায়গায় নির্বাহী কমিটির বৈঠক করতে পারে। কিন্তু বিএনপির বিশাল ‘হিজবুল বহর’ হওয়ায় নির্বাহী কমিটি কয়েক বছরেও একবার বৈঠক করতে পারছে না। এমনকি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নেতা অধিকাংশের জাতীয়ভাবে সুখ্যাতি ও পরিচিতি না থাকায় জেলা ও উপজেলায় গিয়ে সভা-সমাবেশ করলেও বক্তব্য শুনতে সাধারণ উৎসুক মানুষ এগিয়ে আসে না। এ ক্ষেত্রে আগের মতো ছোট কমিটি গঠন করে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পদগুলোতে আসীন করা প্রয়োজন। শুধু পদ দিলেই বড় নেতা হওয়া যায় না– এ বিষয়টিও দলের হাইকমান্ডকে বুঝতে হবে।

একই সঙ্গে দলের নোয়াখালী অঞ্চলের কয়েকজন তৃণমূল নেতা জানান, বর্তমানে জেলা, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ অনেক নেতাই ঢাকায় থাকেন। আন্দোলনের সময় ওইসব নেতাকে তৃণমূল নেতারা কাছে পাননি। অনেকের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। আবার কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতা ব্যবসায়ী হওয়ায় সরকারি দলের সঙ্গে আঁতাত করে চলেন। আন্দোলনের মাঠে থেকে সক্রিয়ভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন না। আগামীতে ভোটের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীর মধ্য থেকে যোগ্য ও ত্যাগীদের পদ-পদবিতে আনা জরুরি। অন্যথায় ভবিষ্যেও সফল আন্দোলন গড়া বিএনপির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে।

এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল। জাতীয় নির্বাহী কমিটির পদ নানা কারণে শূন্য হয়েছে। সেখানে সক্রিয় নেতাদের মধ্য থেকে পদ পূরণ করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া চলমান। বাকি শূন্য পদগুলো দলের হাইকমান্ড সময়মতো পূরণ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

দলে গণতন্ত্রচর্চা জোরদার করা

বিএনপির অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন দলের নেতাকর্মী। তারা বলেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দলীয় ফোরামে সবার মতামতের ভিত্তিতেই নেওয়া উচিত। কিছু ক্ষেত্রে নেতাদের সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তে তা হয় না। দু-একজন নেতার মতামতই দলীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হচ্ছে, যা বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে সহায়ক না হয়ে আরও জটিলতা তৈরি হওয়ার কথা জানান তারা।

সিলেট অঞ্চলের মাঠ পর্যায়ের এক নেতা জানান, বিগত তিনটি নির্বাচনের আগে আন্দোলনগুলোর ব্যর্থতা পর্যালোচনা করলে দলের অনেক ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ চোখের সামনে আসবে। তাতে দলের হাইকমান্ডের কিছু ভুল রয়েছে। আবার দলের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও কিছু ভুল রয়েছে। ঢাকার নেতাদের নিষ্ক্রিয়তাও রয়েছে। কিন্তু যেসব ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপি নেতাকর্মী তথা দেশের মানুষকে আজ খেসারত দিতে হচ্ছে, তার দায় বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এড়াতে পারেন না। ওইসব সিদ্ধান্ত দলীয় ফোরাম, এমনকি বর্ধিত সভা করে গ্রহণ করা উচিত ছিল। একই সঙ্গে তারা বলেন, দলের সর্বস্তরে গণতন্ত্র চর্চা না হলে দলকে আরও মাশুল দিতে হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে সর্বপর্যায়ে পরিবারকেন্দ্রিক পদ-পদবি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

অবশ্য বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কয়েকটি বিষয় সমন্বয় করে বিএনপিকে সামনে এগোতে হবে। তার মধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ দু’জন স্থায়ী কমিটির সদস্য দেশের বাইরে থাকা; মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির দু’জন সদস্য কারাগারে এবং স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য আত্মগোপনে ও প্রকাশ্যে ছিলেন। এ কঠিন পরিস্থিতিতে তৃণমূলে ছোট পদধারী ও পদবি ছাড়া নেতাকর্মী জীবন বাজি রেখে মিছিল করার বিষয়গুলো মূল্যায়ন করেই ভোটের মাধ্যমে জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করতে হবে।

সমকাল