দুর্নীতি লুটপাট ও দু:শাসন, শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা

 

24 Mar, 2023

আরিফুল হক

শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতারা কথায় কথায় ইনডেমনিটির একটি বয়ান হাজির করেন। বয়ানটি এমনভাবে হাজির করা হয় যেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা ঘটনা নিয়েই ইনডেমনিটি আইন তৈরি হয়েছিল। অথচ, শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই দুইটি ইনডেমনিটি আইন তৈরি করে দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। প্রথমটি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে যারা খুন-খারাবি করেছে তাদের পুরো দায়মুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল ইনডেমনিটি আইন। শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় ইনডেমনিটি আইন ছিল আরো ভয়াবহ। রক্ষীবাহিনীকে আগাম দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল শেখ মুজিবের তৈরি দ্বিতীয় ইনডেমনিটি আইন। রক্ষীবাহিনীকে দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি দিয়ে তৈরি করা আইনটিতে বলা হয়েছিল-এই বাহিনী যখন যাকে ইচ্ছা আটক, যে কোন সময় যে কোন জায়গায় তল্লাশি করতে পারবে। এই কাজ করতে গিয়ে তারা যা করবে সবই দায়মুক্ত থাকবে। কোন আদালতে রক্ষ্মিবাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। দায়মুক্তি নিয়েই রক্ষীবাহিনী ৪০ হাজারের বেশি ভিন্নমতের মানুষকে হত্যা করেছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরুণ কিছু অফিসারের অভ্যুত্থানের সময় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান সহ তার পরিবারের সদস্যরা নিহত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই ঘটনায়ও একটি দায়মুক্তি বা ইনডেমনিটি আইন জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকার।

শেখ মুজিব মন্ত্রীসভার ব্যণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে এক অধ্যাদেশ জারি করেন তিনি। যাতে বলাহয় ১৫ আগস্টের সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের সময় যে যে কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে সে গুলো নিয়ে কোনদিন কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা বা প্রশ্ন তোলা যাবেনা। এই অধ্যাদেশই ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ নামে পরিচিত। আওয়ামী লীগ শুধু এই ইনডেমনিটির বয়ান করেন। কিন্তু তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের তৈরি করা ইনডেমনিটি নিয়ে তারা কোন কথা বলেন না।

শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর ২১ বছর পর মুজিব কন্যা হাসিনা ওয়াজেদ ভারতীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর উক্ত ইনডেমনিটি বাতিল করেন। এবং ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের ১৪ জন সেনা অফিসারকে বিচারের নামে হত্যার হুকুম দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের অনুগত আদালত থেকে।

যাঁদের হত্যা করা হয়েছে ও যারা নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন তাঁরা হলেন-কর্নেল ফারুক রহমান (ফাঁসি), কর্নেল শরীফুল ইসলাম ডালিম (নির্বাসিত) লে ফ কর্নেল আজিজ পাশা, কর্নেল কিসমত হাসেম (নির্বাসিত), মেজর বজলুল হুদা (ফাঁসীর নামে খুন) মেজর শাহরিয়ার রশিদ (ফাঁসি) মেজর এ কে এম মহীউদ্দিন (ফাঁসি) ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ (ফাঁসি) ল্যান্সার মহীউদ্দীন (ফাঁসি) সহ লেঃ নাজমুল হোসেন, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর রাশেদ চৌধুরী (নির্বাসিত)।

আসলে শেখ মুজিবকে কি হত্যা করা হয়েছিল, নাকি মুজিব নিজের আদর্শহীনতা, গোঁয়ার্তুমি, এবং অযোগ্যতার জটপাকানো রশিতে গলা আটকে নিজেই নিজের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আবেগ তাড়িত জাতি কোনদিন সেব্যাপারে চিন্তা করার সময়ই পায় নি।

আসুননা আবেগ বিসর্জন দিয়ে, সত্যের আলোকে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালের দিন গুলোকে স্মরণ করি। স্মরণ করি সেদিনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা কেমন আকার ধারণ করেছিল? মুজিব শাসনের দিনগুলো জণকল্যানমূলক ছিল কি? দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার কতটুকু নিশ্চিত ছিল? লুটতরাজের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির অবস্থার কি ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল? কোন স্বাভাবিক উপায়ে সরকার বদলের পথ কি খোলা ছিল? এই প্রশ্নগুলো একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষন করে দেখি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্মের পর, ১৯৭২ সালের জানুয়ারী থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি আদেশে দেশ চলতে থাকে। ডিসেম্বরে সংবিধান পাস হয় এবং সেই থেকে সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলতে লাগল। প্রথম খটকা লাগলো সংবিধান নিয়ে। দেশের সাধারন মানুষ মূলতঃ গণতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু স্বাধীন দেশের প্রথম সংবিধানে দেখা গেল গণতান্ত্রিক কথাটা থাকলেও তার সাথে লেজুড় হিসাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে ‘সমাজ তন্ত্র’ আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যা মুক্তিযুদ্ধে বা আওয়ামীলীগের কোন এজেন্ডায় কোনদিন উচ্চারিত হয়নি। জনসাধারণের ধারনা জন্মালো যে, উক্ত লেজুড় দুটি ভারতের নির্দেশে সন্নিবেশিত হয়েছে। কারণ, সংবিধান পাস করার আগে খসড়া সংবিধান হাতে ব্যরিস্টার কামাল সাহেবকে কেশ কয়েকবার ভারতে ছুটাছুটি করতে হয়েছিল।

৯০ভাগ মুসলমান নাগরিকের দেশে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সূত্র ধরে প্রথমেই মানুষের চিন্তার অস্তিত্বের কনসেপ্টে আঘাত করা হল। দেশ থেকে ইসলাম উৎখাতে নেমে পড়লো শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় মনোগ্রাম থেকে মুছে দেয়া হল কোরানের আয়াত। শুধু তাই নয়, যেখানে যত ইসলাম’ বা মুসলিম শব্দ ছিল সব ধুয়ে মুছে দেয়া হল।

সরকারের চোখের সামনে ভারতীয় লুটেরা বাহিনী পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া উন্নত মানের সমরাস্ত্র-ট্যাংক, কামান গোলাবারুদ, মিলকারখানার মেশিন পার্টস, বিদেশি গাড়ি, দোকান থেকে স্বর্ণালঙ্কার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, এমনকি বাথরুম ফিটিং পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেল। যার মূল্য কম করে হলেও সেই সময়ের ৫০হাজার কোটি টাকার মত হবে।সরকার নিশ্চুপ! ১৯৭৪ সালের ১২ মে ভারতের অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল-‘ভারত দুইশ হইতে আড়াইশো ওয়াগন ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে স্থানান্তরিত করেছে’। বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল প্রতিবাদ করায় তাকে কারাবন্দি করা হল। মেজর জলিল আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী’।

শেখ মুজিব, সরকার প্রধান হয়ে দেশটাকে পৈত্রিক লাখেরাজ সম্পত্তির দেশ বানিয়ে ফেলেন। যেখানে যত আত্মীয় স্বজন ছিল-ভাই ,ভাগ্নে, ভগ্নীপতি, ভাতিজা সকলকে টেনে এনে মন্ত্রিত্ব এবং সরকারি পদ পদবী বিলিবন্টন করে দিলেন। ফলে সরকার পরিণত হল একদল অযোগ্য মানুষের আখড়ায়। সরকারের এডমিনিস্ট্রেশন বলতে কিছু থাকল না।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসাবে নানান দেশ থেকে ৫০লক্ষ স্টার্লিং পাউন্ড সাহায্য এল। যা দিয়ে দুইটা বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে বলে বলা হল। সব লুটপাট হয়ে গেল। রিলিফের খাদ্য সামগ্রী কলকাতার ফুটপাথে বিক্রী হতে দেখা গেল। মুজিব সাহেব বললেন, এতদিন খাইছে অদের লোক, অখন খায় আমার লোক। আত্মীয়স্বজন ও দলের লোকজনদের অবিরাম লুটপাটের ফলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়লো। দেশে ধেয়ে এল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।

শেখ মুজিব আমলের সেই ভয়াবহ মহাদুর্ভিক্ষের হৃদয়বিদারক চিত্র, ১৯৪৩ সালে আঁকা শিল্পী জয়নুল আবেদীনের বিখ্যাত দুর্ভিক্ষের চিত্রগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়। পথে পথে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের লাশ ছড়িয়ে আছে। ১০লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল খাবার না পেয়ে। ২লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল পুষ্টিহীনতায়। ১লক্ষ মারা গিয়েছিল বিনাচিকিৎসায়। মানুষের পরনের কাপড় নেই। কাপড়ের অভাবে গ্রামের বাসন্তীরা মাছের জাল জড়িয়ে লজ্জা নিবারনের চেষ্টা করছিল। অর্ধ উলঙ্গ নারীরা লজ্জা ভুলে রাস্তায় নেমে মিছিল করতে বাধ্য হয়েছিল। কাপড়ের অভাবে লজ্জায় মানুষ আত্মহত্যা করেছে। সেই দুর্ভিক্ষ যারা নিজ চোখে না দেখেছে তারা আজ কল্পনা করতে পারবেনা তার ভয়াবহতা। মানুষ বাঁচার জন্য গাছের পাতা চিবিয়ে খেয়েছে , ডাস্টবিন থেকে পচা খাবার কুড়িয়ে খেয়েছে । দেশে যখন খাওয়ার অভাবে শতশত মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন মুজিব সাহেবের বাড়ীতে হীরার মুকুট মাথায় পরিয়ে বধূবরণ চলছে। ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টালের ‘সাকী’ বারে চলছে সরকার পোষ্য কালোবাজারি পাচারকারীদের বিদেশি মদের ফোয়ারা উৎসব। আসলে এই দুর্ভিক্ষ এই মহামরণ প্রাকৃতিক ছিলনা, ছিল ম্যানমেড। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় (৮ই নভেম্বর ১৯৭৪) সংখ্যায় এইস ডি এস গ্রীনওয়ে লিখেছিলেন ‘সারা দেশে ফসল নষ্ট হয়নি। ঘাটতিটুকু অনায়াসে কাটিয়ে ওঠা যেত। কিন্তু সরকারি অক্ষমতা, ব্যাপক দুর্নীতি, ভারতে চাল পাচার প্রভৃতির জন্য তা একটা জাতীয় বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে’।

দেশে আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছুই ছিলনা। শ্লোগান দেয়া হত “আইনের শাসন মানিনা, মুজিবের শাসন মানি”। বিদেশী সংবাদপত্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হাইজ্যাক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ২২হাজার, চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৬০হাজার, ব্যাংক লুট হওয়ার ঘটনা ঘটে ১৫০টি । আগুন দেয়া হয় ৭২ পাটের গুদামে, দেশ থেকে পাচার হয় ১০হাজার কোটি টাকার মালামাল। সরকারী দলের লোকজন পাকিস্তানিদের বা উর্দু ভাষাভাষীদের বা ভিন্নমতাবলম্বীদের শিল্প প্রতিষ্ঠান দোকান, বাড়িঘর দখল করে প্রায় ১৩ হাজার, জমি দখল করে ৫০হাজার একর। অস্ত্র লুট হল ১৫০০০, ধর্ষনের ঘটনা ঘটে অগণিত।

যে কোন কারনে হোক শেখ মুজিব দেশের সেনাবাহিনীর উপর বিশ্বাস করতেন না । দেশের গৌরবময় সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করে তিনি ভারতীয় বেশভূষায় ভারতীয় ট্রেনিংয়ে রক্ষীবাহিনী নামক নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন। সেসময় দেশ রক্ষার সেনাবাহিনী সদস্যদের পোষাকের অভাবে লুঙ্গী পরে কেডস পায়ে প্যারেড করতে দেখা গেছে। অথচ রক্ষীবাহিনীর জন্য উন্নতমানের পোষাক ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। এই রক্ষীবাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিলনা । রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালিত হত সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের দপ্তর থেকে। রক্ষীবাহিনী ছিল এক আতঙ্কের নাম । এরা কাউকে স্পর্শ করলে তার গায়ের চামড়া থাকতোনা। কাউকে গ্রেফতার করলে থানা বা জেলখানায় পাওয়া যেতনা, দু তিনদিন পর খালে বিলে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যেত। মুজিবের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছে তাঁদেরই হত্যা করা হয়েছে। সে সময় রক্ষীবাহিনী প্রায় ৪০হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল।

শেখ মুজিব কোন সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। তার রাজনৈতিক গুরু মওলানা ভাসানীকে গৃহবন্দী করেছিলেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মুক্তিযোদ্ধা শিরাজ শিকদার কে গ্রেফতার অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিল। পরে সংসদে দাঁড়িয়ে সদম্ভে শে মুজিবুর রহমান বলেছিলেন (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) “কোথায় আজ সেই শিরাজ শিকদার”। এই যুগে জনগনের নির্বাচিত কোন নেতা এধরনের উক্তি করতে পারেন কিনা আমার জানা নেই।

শেখ মুজিব তার শাসনতান্ত্রিক ব্যর্থতা চাপা দিতে গিয়ে রক্ষীবাহিনী ছাড়াও লালবাহিনী, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ নামের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন। এসব বাহিনীর নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাটে কত হাজার পরিবার যে সর্বশান্ত হয়েছ সর্বহারা হয়েছে, নির্যাতিত, গুম, পঙ্গু হয়েছে তার পরিসংখ্যান দিতে গেলে কয়েক খন্ড পুস্তকের প্রয়োজন পড়বে। দেশের ৯৫% মানুষ সেই অপশাসন থেকে নিষ্কৃতি চাইছিল, কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছিলনা।

শেখ মুজিব ও বুঝতে পারছিলেন তার গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোটায় নেমে গেছে, এ অবস্থায় ক্ষমতায় বেশিদিন থাকা যাবেনা। তখন তিনি তার ব্যক্তিগত বিশ্বস্ত মানুষের সাথে পরামর্শ করে এমন এক পথ বের করলেন যে পথে কেউ কোনদিন তাকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরাবার কথা চিন্তাও করার সুযোগ থাকবে না।মুজিব সেই পথের নাম দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব।

১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে মাত্র কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে এক বিল পাশ করা হয়। দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে গলাটিপে হত্যা করে এক নেতার বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হল এই বিলের মাধ্যমে। এরই নাম দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লব । জনগণের দীর্ঘকালের আকাঙ্ক্ষা লালিত গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটল। মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকারের পরিবর্তে চালু হল একক ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রপতি শাসন পদ্ধতি । দেশের বহুদলীয় রাজনীতি বিলুপ্ত হল, চালু হল একদল বাকশাল পদ্ধতি। সরকারের নিয়ন্ত্রণে মাত্র ৪টি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা রেখে সমস্ত পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে সংবিধানের ৯৭, ১০২, ১০৯, ১১৫, ১১৬ ধারাগুলোর ব্যাপক রদবদল করা হল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা জনগনের মৌলিক অধিকার বলতে কিছুই থাকলনা। সংশোধনীর মাধ্যমে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করা হল। জনগনের বাকস্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেয়া হল।

দেশ নিঃস্ব রিক্ত, অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়েছে, বিদেশিরা “bottomless basket” আখ্যায়িত করে সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে, একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পাট শিল্প ধংস, দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন অথচ জালেম সরকারকে সরাবার কোন পথ নেই। দেশপ্রেমিক কিছু তরুণ সেনা সদস্যের এক সফল অভ্যুত্থানে তখন শেখ মুজিবুর রহমানের অপশাসন মুক্ত হয়েছিল দেশ। এবার সেই মূল্যবান প্রশ্ন- শেখ মুজিবের বাকশাল আইনে সাংবিধানিক উপায়ে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে সরানোর আদৌ কোন পথ খোলা ছিল কি?

বর্তমানে দেশ মুজিব আমলের চাইতেও বেশি দুর্দশায় পড়েছে। শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ইনডেমনিটি আইন তৈরি করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেপুটে কোষাগার শূন্য করছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে ইনডেমনিটি আইন তৈরি করে লুটপাটের ইতিহাস বিরল। রক্ষীবাহিনীর আদলেই র‌্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে সাজানো হয়েছে। শেখ হাসিনার হুকুমে তারা গুম, খুন করছেন ভিন্নমতের রাজনৈতিক কর্মীদেরকে। আইন ,বিচার, অর্থনীতি, বাজার ব্যবস্থা, দেশের মান ইজ্জত সুরক্ষা সবকিছু ভেঙে পড়েছে। দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। বিরোধীদলের লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মী নিপীড়নের শিকার। অনেকেই প্রাণ দিচ্ছেন, জেলে পচে মরছেন। কিন্তু মানুষ স্বৈরাচার হটানোর পথ খুঁজে পাচ্ছেনা। বিদেশি শক্তির মুখ তাকিয়ে আছে তাদের স্যাংশন দেয়ার আশায়। শান্তি মিশনে বিদেশে ভাড়াখেটে সুনাম অর্জনকারী সেনাবাহিনীও নির্বিকার। যে দেশের মানুষে দেশপ্রেমিক সেনাসদস্যদের ফাঁসি দিয়ে মারা উপভোগ করে, পিলখানায় ৫৪জন সেনা অফিসারকে হত্যার পরও প্রতিবাদে ফেঁটে পড়েনা, সেই বিবেকহীন জনগোষ্ঠীর স্বাধীন থাকারও কোন অধিকার নেই, এটাই ইতিহাসের বিধান।

লেখক: বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক

উৎসঃ   আমার দেশ