বাজেট কেবল আয়–ব্যয়ের হিসাব নয়। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপত্রও। বাজেটে যে কর আরোপ করা হয়, দেশের প্রত্যেক মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার জোগান দিতে হয়। ফলে তাঁরা বাজেট থেকে কী পাবেন, সেই হিসাবটাও নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে প্রধান দুটি সমস্যা হলো দুর্নীতি ও বেকারত্ব। দুর্নীতি কমলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। তখন কর্মসংস্থান বাড়বে। ফলে বেকারত্ব কমবে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কর্মসংস্থানের চেয়ে প্রবৃদ্ধির দিকেই ধাবিত হলেন। ফলে দেশে বড় বড় অবকাঠামো হলো, কিন্তু বেকারত্ব কমল না।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিল। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১০০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচিও নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কর্মসূচি নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠায় পরে আর এগোয়নি। এখন আর ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা শোনা যায় না।
বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণায় হতাশই হলাম। তিনিও পূর্বসূরির পথেই কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ দিলেন।
দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে কোনো টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেন না। দুর্নীতির সঙ্গে বেকারত্বের নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। যে দেশে দুর্নীতি কম, সে দেশে ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারত্বের যে হিসাব দাখিল করে, সেটা কেবল অবিশ্বাস্য নয়, হাস্যকরও। তাদের হিসাবে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার।
বিআইডিএসের গবেষণায় উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ৬৬ শতাংশ বেকার। এর আগে তাদের অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শিক্ষিত তরুণদের ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ সম্পূর্ণ বেকার।
বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ রেলওয়ে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ ওয়েম্যান নিয়োগ দিয়েছে, তাঁদের সবাই মাস্টার্স পাস। এই পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এসএসসি পাস। তাঁরা নিজেদের শিক্ষাগত পরিচয় গোপন করে চাকরি নিয়েছেন। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি কাজে যোগদান করার পর অনেক ওয়েম্যানই তাঁদের চাকরি ছেড়েও দিয়েছেন।
যেদিন বাজেট ঘোষণা হলো, সেদিনই এক নারীর করুণ কাহিনি প্রকাশিত হলো প্রথম আলো অনলাইনে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাসিন্দা সীমা আক্তার ২০২২ সালের মার্চে কাজের সন্ধানে দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে ভারতে যান। পারলারের কাজের কথা বলে তাঁকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বেঙ্গালুরুতে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হন এবং অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে দুই বছরের সাজা খাটেন। পরে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের মাধ্যমে প্রায় আড়াই বছর পর সীমা পরিবার ও সন্তানের কাছে ফিরতে পেরেছেন। অনেকেই পারেন না।
দালালদের খপ্পরে পড়ে, তথাকথিত জনশক্তি রপ্তানি সংস্থার মাধ্যমে যে হাজার হাজার তরুণ–তরুণী বিদেশে গিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হন, তা–ও দেশে কর্মসংস্থান না থাকার কারণে।
কয়েক দিন আগে মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকদের একটি খবর বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। তৃতীয় দফা বন্ধ হওয়ার পর গত বছর মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ শ্রমিক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট পেয়েও ১৭ হাজার শ্রমিক যেতে পারেননি। আমরা এতটাই সক্ষমতা অর্জন করেছি যে নির্ধারিত সময়ে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাতে পারি না। এই তরুণেরা প্রত্যেকে পাঁচ লাখের বেশি টাকা দিয়েছেন কথিত এজেন্সিকে।
দেশে যখন চাকরির আকাল, তখনই উচ্চ আদালত থেকে একটি রায় এল সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করার সিদ্ধান্ত অবৈধ। এই রায় মেধাবী তরুণদের আরও বেশি হতাশার দিকে ঠেলে দেবে।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল কোটা পুরোপুরি বাতিল করতে নয়। আন্দোলনকারীরা বলেছিলেন, কোটা যুক্তিসংগত হোক। মেধাবীরা সুযোগ পাক। কিন্তু সরকার গোয়ার্তুমি করে পুরো কোটাই বাতিল করে দেয়। এতে নারী, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
আর কোটা পদ্ধতি বাতিল হয়েছিল প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে। নিচের ধাপের কর্মীদের কোটা এখনো বহাল আছে।
অনেক দেশে সরকার বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত বেকার ভাতা দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সে রকম কিছু করার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা সরকারের নেই।
বরাবরের মতো এবারও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বেকারদের জন্য কোনো সুখবর নেই। বর্তমানে জনপ্রশাসনে পৌনে চার লাখ পদ খালি আছে। সরকার কোটা নিয়ে টানাটানি না করে পৌনে চার লাখ শূন্য পদ অবিলম্বে পূরণ করুক। তাতে অনেক বেকার কাজ পাবেন।