ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান অর্থনীতিবিদ এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. অবিনাশ দীক্ষিত তাঁর এক জার্নাল প্রবন্ধে লিখেছেন, দুর্নীতি দমনে ব্যক্তি খাতের শিল্পকারখানার মালিকদের তরফ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করলে, তা হবে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও দ্রুত। তাঁর মতে, সব মালিকপক্ষ যদি একজোট হতে পারে এবং ঘুষ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে তারা সরকারি দপ্তর থেকে ঘুষ ছাড়াই কাজ উদ্ধার করতে পারবে। প্রথম দিকে হয়তো অনেক দিন লেগে যাবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কালক্ষেপণ না করেই কাজ সমাধান করতে পারবে।
কৌটিল্য তাঁর প্রণীত ‘অর্থশাস্ত্রে’ রূপকার্থে বলেছেন, ‘জলের মধ্যে বাস করা মাছ জল খাচ্ছে কি না, তা বোঝা সম্পূর্ণ অসম্ভব’। এ কথার অর্থ হলো, কোনো সরকারি কর্মকর্তা সেবাদানে নিয়োজিত থেকে অর্থ তছরুপ করছেন কি না, তা খুঁজে বের করা কঠিন। কৌটিল্য তারপর বলছেন, দুর্নীতি রোধ করতে হলে অসৎ আমলাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। অর্থনীতির মূলধারা বিশ্বাস করে, মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের খায়েশের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কর্নেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর অবস্থান অবশ্য এর বিপরীতে। তাঁর অবস্থানের সমর্থনে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক মার্ক হসারকে উদ্ধৃত করেন। বলেন—সততা, সমাজবাদী চেতনা ও ন্যায়-অন্যায় বোধ ব্যক্তি মানসের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। অর্থাৎ সৎ মানুষ অবশ্যই আছে এবং রাষ্ট্রের সেবা দানে তাদেরকেই নিয়োগ দিতে হবে।
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ নির্মাণ করতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা জরুরি। শুধু তাই নয়, একজন দুর্নীতিবাজ, সে যতই অর্থ-সম্পদের মালিক হোক না কেন, তাঁর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা একটি সামাজিক রীতি হয়ে উঠতে হবে। যেসব সংগঠন, গণমাধ্যম ও ব্যক্তি দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি জনমত গঠনে সহায়তা করবে, তাদের জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করতে হবে।
১৯৬২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ভারতীয় রাজনীতিবিদ কে সান্থানামের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। তদন্ত শেষে তারা একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন পেশ করে। যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার কথা কমিটি বলেছিল, তার কয়েকটা এখানে উল্লেখ করি। অর্থনৈতিক কাজকর্মে গতি আনতে হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি হতে হবে অনেক সহজ ও সংক্ষিপ্ততম। সরকারি দপ্তরে একেবারে নিচের দিকে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের বেতন বাড়াতে হবে, যাতে বেঁচে থাকার জন্য কিছু উপরি আয়ের লক্ষ্যে তাঁদের অসৎ উপায় অবলম্বন করতে না হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে হবে, যাতে শিক্ষিত ও সৎ তরুণ-তরুণীরা এই চাকরিতে আসেন। সরকারি পদধারী ব্যক্তিদের নিজস্ব বিবেচনায় টাকা খরচ করার বিধান বাতিল করতে হবে অর্থাৎ প্রতিটি পয়সা খরচের যৌক্তিক হিসাব তাঁদের দাখিল করতে হবে।
দুদক বা এ জাতীয় তদারক সংস্থা গঠন করতে হবে বিশেষজ্ঞ এবং সমাজে সৎ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত ব্যক্তিবর্গ দিয়ে। এ জাতীয় সংস্থাকে হতে হবে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচারকাজ হতে হবে সহজ কিন্তু কঠোর এবং দ্রুত। সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াও হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অভিযোগ প্রমাণের আগে ও পরে কারাগারে বন্দীদের মধ্যে কোনো ‘ডিভিশন’ তথা স্তরভেদ থাকা চলবে না।
যখন কোনো সরকারি প্রকল্পের কাজ হয়, তখন সব খরচ, শ্রমিকের মজুরি, আয়, মুনাফা—সবকিছুর তালিকা প্রকল্পস্থলে সাইনবোর্ডে টাঙাতে হবে। সমাজের যেকোনো মানুষ ইচ্ছা করলে যাতে উপাত্তগুলো বাজারদরের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে। কল্যাণ অর্থনীতির গুরু রবিন ব্রডওয়ে মনে করেন, এ রকম বাধ্যবাধকতা দুর্নীতি কমাবে। শুধু সরকারি কর্মচারী, কর্মকর্তাই নয়—ব্যক্তি খাত থেকে যেসব মানুষ ঘুষের বিনিময়ে সরকারি কাজ বাগিয়ে নেন, তাঁদের জন্যও কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে অনুদান দিলে, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ—এমন আইন করতে হবে। কেউ দুর্নীতির কোনো ঘটনা রিপোর্ট করলে, তাঁকে সুরক্ষা দিতে হবে।
কর ফাঁকি বাংলাদেশে একটি বিরাট সমস্যা। করযোগ্য আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। যাঁরা কর ফাঁকি দেন, তাঁরা সাধারণত তিনটি উপায় অবলম্বন করেন। (১) আয় গোপন করা, (২) কর ফাঁকি দিতে আয় কম করে দেখানোর জন্য ফার্ম বা কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা ও (৩) ঘুষের মাধ্যমে ট্যাক্স ইন্সপেক্টরের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা। তৃতীয় ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারী জড়িত। এটা ঠেকাতে অর্থনীতির তত্ত্বের আলোকে বাথ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক অজিত মিশ্র কিছু প্রস্তাব করেন—সরকারকে তথ্য ও তদারকসংক্রান্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, জিপিএস ব্যবহার ও প্রতিবার দেখা করার ভিডিওগ্রাফি বাধ্যতামূলক করতে হবে, স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার প্রযুক্তি মাধ্যমে ক্রসম্যাচিং সিস্টেম চালু করতে হবে। এতে ট্যাক্স ইন্সপেক্টরের পক্ষে তথ্য গোপন করা সম্ভব হবে না। ফলে করদাতাও কর ফাঁকি দিতে পারবেন না। যেসব কনসালট্যান্ট বা ফার্ম কর ফাঁকি দিতে সহায়তা করবে, তাদের নিবন্ধন বাতিলসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা অপরিহার্য। এ জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা দরকার। সব ক্ষেত্রেই কর ফাঁকির শাস্তি হতে হবে গুরুতর।
একটি দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত হলো একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ নির্মাণ আর সততা, সমাজবাদী চেতনা, ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই—এমন ব্যক্তির বসবাস যে সমাজে, সেই সমাজ দুর্নীতিমুক্ত করা অসম্ভব। দুর্নীতি একটা অসুস্থ সমাজের লক্ষণ, যেখানে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হলো, মানুষের নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার উপায় কী? সবচেয়ে প্রধান উপায় হচ্ছে, নৈতিকতা শেখায় এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা বা এমন একটি আবহ সারা দেশে সৃষ্টি করা। পাঠক লক্ষ করুন, বলা হচ্ছে ‘শিক্ষার ব্যবস্থা’—শিক্ষাব্যবস্থা নয়। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থার অধীন বিদ্যালয় শিশুকে যে শিক্ষা দান করে, তার চেয়ে বেশি শিক্ষা সে পায় মাতা-পিতা, সমাজ ও পরিপার্শ্ব থেকে। বিদ্যালয়ের চেয়েও মাতা-পিতা, সমাজ ও পরিপার্শ্ব থেকেই নৈতিকতার শিক্ষাটা শিশু বেশি পায়। অর্থাৎ নৈতিকতার শিক্ষা দেয় এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি সমগ্র দেশেই নৈতিকতা শিক্ষার একটি ব্যাপক আয়োজন দরকার।
নৈতিকতা শিক্ষার কথা অনেক বলা হয়, কিন্তু যেটা বলা হয় না, তা হলো সমন্বিত জীবনচেতনার কথা। পৃথিবীর প্রায় সব সফল শিক্ষাব্যবস্থাই বাজার অর্থনীতির শিক্ষা দেয় আর বাজার অর্থনীতির মূল চেতনা হলো প্রতিযোগিতা। এসব শিক্ষাব্যবস্থার প্রণেতারা জানেন না যে প্রতিযোগিতা নয়, বরং সহযোগিতা হলো মানবসভ্যতার অন্তপ্রবাহ। এই তথাকথিত সফল শিক্ষাব্যবস্থা যে শিশুটিকে গড়ে তুলল, সে বড় হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যেকোনো মূল্যে তাকে সম্পদের মালিক হতেই হবে—এমন মনোভাব দ্বারা তাড়িত, আর দুর্নীতিই হবে তার একান্ত আশ্রয়। অতএব, এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দরকার, যা শিশুদের সমন্বিত জীবনচেতনার শিক্ষা দেবে।
দুর্নীতিমুক্ত সমাজ নির্মাণ করতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা জরুরি। শুধু তাই নয়, একজন দুর্নীতিবাজ, সে যতই অর্থ-সম্পদের মালিক হোক না কেন, তাঁর প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা একটি সামাজিক রীতি হয়ে উঠতে হবে। যেসব সংগঠন, গণমাধ্যম ও ব্যক্তি দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি জনমত গঠনে সহায়তা করবে, তাদের জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করতে হবে। ওপরে উল্লেখিত অধ্যাপক অবিনাশ দীক্ষিতের তত্ত্বের আলোকে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ যদি আমরা নির্মাণ করতে চাই, তাহলে শুধু দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই নয়, সমাজের যেকোনো অসৎ ব্যক্তি এবং অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে ব্যক্তি খাতের এমন ব্যবসায়ী—সবাইকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। তাহলে একদিন এমন একটি সমাজ হবে, যেখানে কোনো দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, অসৎ ব্যবসায়ী ও নৈতিকতাবর্জিত মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ধারণা আস্তে আস্তে কমে আসবে।
- ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]