today-is-a-good-day

“দুগ্ধের বিশ্বাসে বিষ খাইলে বিষ আপনার শক্তি অবশ্য প্রকাশ করে”। রামমোহন রায়

“দুগ্ধের বিশ্বাসে বিষ খাইলে বিষ আপনার শক্তি অবশ্য প্রকাশ করে”।

কার কথা? রামমোহন রায় (মে ২২, ১৭৭২ – সেপ্টেম্বর ২৭, ১৮৩৩)। আজকালকার না। সেই কবেকার কথা। কিন্তু রামমোহন মনে পড়ল কেন? ঢাকা সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচনের পর দুনিয়ার যতো আকথা কুকথা বকোয়াজগিরি শুনতে শুনতে মাথা খারাপ হবার জোগাড়! তখনই রামমোহন রায়ের এই অমূল্য বাণী মনে পড়ল।

কেন? ভাবুন, নির্বাচন কি গণতন্ত্রের জন্য বিষ না অমৃত? আপনি দুগ্ধের বিশ্বাসে ‘নির্বাচন’ পান করলেন, কিন্তু বুঝলেন না ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফ্যাসিস্টগণ আপনার কাছে বিষ বেচতেছে। যদি কেনেন ও খান তাহলে গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দিলেন। ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাকে আরও পোক্ত করলেন। তারে ন্যায্যতা দিলেন। আরও লুটপাটের ক্ষমতা তুলে দিলেন। মরলেন।

গণতন্ত্র মানে নির্বাচন না। গণতন্ত্র যদি থাকে কেবল তখনই নির্বাচন ছহি, অর্থাৎ তখনই সেটা গণতন্ত্র চর্চার প্রকরণ হতে পারে। গণতন্ত্র নাই, তো আপনি নির্বাচন দিয়া কি করবেন? কাকের মাথায় ময়ূরের পালক দিলে তাকে কাউয়াই বলে। বরং ময়ূরের ডিম খোঁজেন, অর্থাৎ গণতন্ত্রের মর্মকথা আগে বোঝেন। গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনায় তা দিতে শেখেন, যেন ওমে্র যত্নে ময়ূর ফোটে, এবং একসময় পেখম মেলে আপনাকে গণতন্ত্রের মজা দিতে পারে। নইলে গণতন্ত্র ভেবে নির্বাচন খাবেন তো বিষই খাবেন, নিজেদের বারোটা বাজাবেন।

যদি গণতন্ত্র থাকত তারপরও আপনাদের বোঝাতে হোত নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক চর্চা। সেই দিকটা গণতন্ত্রের গোড়াও নয়। গণতন্ত্রের গোড়ায় রয়েছে ব্যক্তির মানবিক ও নাগরিক অধিকার কায়েম এবং তা বলবৎ করবার জন্য উপযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। সেই অধিকার যেন কেউ পরিবারের নামে, জাতির নামে, ধর্মের নামে, সিকিউরিটির নামে কিম্বা অন্য কোন অজুহাতে কোন রাষ্ট্র কোন সেনাপতি কোন রাজা কোন রাণী কিম্বা মঙ্গল গ্রহের কোন এলিয়েন হরণ করতে না পারে তার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করাকে গণতন্ত্র বলে। তার মানে রাষ্ট্র চাইলেই যা খুশি আইন প্রণয়ন করতে পারে না, আপনার ভোট নিয়ে আপনার সম্পদ লুট করতে পারে না। পারে কি? আগে ডাকাত তাড়ান, গণতন্ত্র পরের ব্যাপার। নির্বাচনকে তাই গণতন্ত্র বলে না। সেটা গণতন্ত্র চর্চার একটি দিক মাত্র।

গণতন্ত্র মানে সবার আগে জনগণের পূর্ণ অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক গঠ্নতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার (Constitution) আদায়। যার ভিত্তিতে নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ক্ষমতা, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার জায়গায় জনগণের ক্ষমতা কায়েম করা। একজন রাজা বা রানীর হাতে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা কোন ভাবেই যেন কেন্দ্রীভূত হতে না পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল স্তরে জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারে। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার কায়েমের জন্য লড়েছি। এই তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক আদর্শ। তাহলে কাজ হচ্ছে এই তিন আদর্শ কায়েম করবার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। গণতন্ত্র নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়ণী বিভাগ এবং বিচার ব্যবস্থাকে এমন ভাবে গড়ে তোলা যাতে প্রতিটি ব্যক্তির নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা যায় এবং স্বাধীনতা ঘোষণার তিন নীতি প্রতিষ্ঠা করা যায়। গণতন্ত্র কায়েম থাকলে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও বিধানাদির ভিত্তিতে কাউকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করবার সম্মতি দেওয়াকে নির্বাচন বলে। না থাকলে গণতন্ত্র হরণকারীদের হাতে আপনার গলায় ছুরি চালাবার ক্ষমতা তুলে দেওয়া বোঝায়।

নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করবার কোন অধিকার রাষ্ট্রের থাকতে পারে না, দুই তৃতীয়াংশ ভোটে পার্লামেন্ট নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণকারী যা খুশি আইন পাশ করতে পারে না। যদি পারে তবে সেটা গণতন্ত্র না, গণতন্ত্র থাকে না। তাই বাংলাদেশের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে গণতন্ত্রহীন ব্যবস্থার উৎখাত, নাগরিক ও মানবিক অধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা এবং গণতন্ত্র হরণকারীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

বহুবছর ধরে আমি এই কথাগুলোই বারবার বলে হয়তো বিরক্তির কারন হয়েছি। তাই এখন রামমোহনের বরাতে বলছি: “দুগ্ধের বিশ্বাসে বিষ খাইলে বিষ আপনার শক্তি অবশ্য প্রকাশ করে”। নির্বাচনকে গণতন্ত্র ভাবিয়া নির্বাচন করিলে সেই দেশের জনগণের বারোটা বাজিবার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়। দেশ মরে।