দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছে : বিশেষ সাক্ষাৎকার: বদরুদ্দীন উমর

দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছেবদরুদ্দীন উমর

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

ছাত্র আন্দোলন থেকে গণঅসন্তোষ এবং জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা। কোন পথে বাংলাদেশ? এ নিয়ে কথা বলেছেন গবেষক ও বামপন্থি রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

সমকাল: ছাত্র আন্দোলনের বর্তমান পর্যায় সম্পর্কে বলুন।

বদরুদ্দীন উমর: ছাত্র আন্দোলন আর কোটা সংস্কারে আটকে নেই। এটা এখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। দেখা যাবে, কোনো আন্দোলন শুরু হতে পারে ছোট কোনো ঘটনা নিয়ে। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল একটা হত্যাকাণ্ড নিয়ে। পরে তা অন্যদিকে গড়িয়েছে। ১৯৫২ সালের আন্দোলনও শুরুতে ছাত্র আন্দোলনই ছিল। পরে তা জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের জনপ্রিয়তা শুধু চাকরি দাবির জন্য বা কোটা-বৈষম্যের জন্য হয়নি। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের জুলুমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ যদি এই আন্দোলনে যুক্ত না হতো, তাহলে কোটা সংস্কার আন্দোলন এত বড় আকার ধারণ করত না। এটা এখন দেশজুড়ে জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

সমকাল: বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির চরিত্রটা কী? কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো?

বদরুদ্দীন উমর: বর্তমান যে পরিস্থিতি, এটা আসলে একটা গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ছাত্রদের আন্দোলন দমনের চেষ্টার ফলে। তাদের গুলি করা হলো, ‘রাজাকার’ বলা হলো। এর বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এদিক দিয়ে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের যে গণঅভ্যুত্থান, তার সঙ্গে এটার তুলনা করা চলে। কেননা সেই আন্দোলনও ছাত্র আন্দোলন থেকে বড় আকারে সারাদেশে একটা গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। প্রথম দিকে লোকে মনে করেছিল, এটা শুধু ছাত্রদের আন্দোলন। কিন্তু ছাত্র আন্দোলন পরিণত হলো জনগণের আন্দোলনে। কারণ, সে সময় জনগণের মধ্যে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ কাজ করেছিল। জনগণ ভেবেছিল, পাকিস্তান হবে সোনার দেশ। কিন্তু দেখা গেল, কিছুই তারা পেল না। সে সময়ে দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ জমা হয়েছিল। তারই প্রকাশ ঘটে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে ঘটেছিল। এদিক দিয়ে এখনকার অবস্থা ’৫২ সালের সঙ্গে তুলনীয়। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনও জনগণের বিরাট গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। এটা হয়েছে সরকারের কারণে। বায়ান্ন সালে সরকার ছাত্রদের বুকে গুলি করেছিল, এখনও তেমনি ছাত্রদের বিরুদ্ধেই সরকারের অবস্থান। ছাত্রছাত্রীদের কথা না শোনা, তাদের ওপর নির্বিচার গুলি করার ঘটনা ঘটেছে। ফলে জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের মনে সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্ষোভ জমে আছে। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাপক চুরি-দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, চারদিকে জেলজুলুম, নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহীনতা, সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ততা। এই আন্দোলন জনগণের সেই সুপ্ত ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ছাত্র আন্দোলন ১৯৫২ সালের মতোই বিরাট গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। কাজেই এটাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশে আগে যে চারটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে– ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১-এর মার্চ ও ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের থেকে এই আন্দোলন অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, আগের গণঅভ্যুত্থানগুলোর সময়ে জনগণের সরকার বিরোধিতা যে মাত্রায় ছিল, এবারের সরকার-বিরোধিতা তার চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণেই বিরোধিতা সংঘর্ষের আকার ধারণ করেছে।

সমকাল: সরকার এ পরিস্থিতির জন্য বিএনপি এবং তাদের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছে। এমনকি জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধও করা হয়েছে।

বদরুদ্দীন উমর: এত খুন, এত হত্যা, মানুষের মৃত্যু এবং চারদিকে যে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড, এর দায়দায়িত্ব কাদের ঘাড়ে চাপাবে– তা নিয়ে আওয়ামী লীগ অস্থির আছে। বরাবরই তারা যে কাজটা করে থাকে, অন্য কিছু না দেখে তারা বিএনপি ও জামায়াতকেই সবকিছুর জন্য দায়ী করে। নিজেরা গুলি করে ছাত্রদের মারছে; কিন্তু তাদের এ কথা বলতে কোনো লজ্জা নেই যে বিএনপি গুলি করছে। আশ্চর্য ব্যাপার, এর চেয়ে বড় ধাপ্পাবাজি আর কিছু হয় না। তারা বলছে, বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী। জিয়াউর রহমান তো ২৫ মার্চের আক্রমণের পরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর দ্বিতীয় দফায় তিনি এই স্বাধীনতা ঘোষণা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে করেছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে লড়াই করেছিলেন। কোন ভিত্তিতে তাঁকে রাজাকার বলা যেতে পারে? এটা ইতিহাসের চরম বিকৃতি এবং অসত্য ভাষণ ছাড়া আর কিছু না। বিএনপি আওয়ামী লীগের মতোই শাসকশ্রেণির একটা দল। কিন্তু তাদের বাংলাদেশবিরোধী বলার কোনো যুক্তি নেই। অন্যদিকে এটা সত্যি, জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে অনেক রকম দুষ্কর্ম করেছিল। মানুষ খুন পর্যন্ত করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পরে তাদের তো সেই অবস্থান নেই। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম দফায় জেলে দিলেও পরে তাদের মুক্ত করেছিলেন। তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশ গড়ার। তার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী অন্য যা-ই করুক, তাদের কর্মসূচির মধ্যে বাংলাদেশবিরোধী কোনো কিছু দেখা যায়নি। তারা পাকিস্তানের জয়জয়কার করেনি। পাকিস্তান ফিরিয়ে আনতে চায় বলেও দেখা যায়নি। আমরা তাদের বিরোধিতা করি, কারণে এই নয় যে তারা বাংলাদেশবিরোধী। আমরা তাদের বিরোধিতা করি এ জন্য যে, জামায়াতে ইসলামী সংগঠন চরম দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন। হাজার রকম অপরাধ করা যায় বাংলাদেশ স্বীকার করে নিয়েই। আওয়ামী লীগ নিজে বাংলাদেশ স্বীকার করে নিয়েই যেসব কাজকর্ম করেছে, তার বিরুদ্ধেই তো বর্তমানে আন্দোলন হচ্ছে।

সমকাল: ছাত্রদের ‘রাজাকার’ বলার কৌশল বুমেরাং হয়েছিল, ছাত্র আন্দোলন বিপুল আকার ধারণ করেছিল। এখন জামায়াত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কাকে খুশি করবে? এর মাধ্যমে কি পরিস্থিতি শান্ত হবে? সরকার কি লাভবান হবে?

বদরুদ্দীন উমর: জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তটা আদতে একটা ফাঁকা আওয়াজ। ১৯৭১ সালে চীনও বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। একসময় বিরোধিতা করলে যে চিরদিনই বিরোধী থাকবে, এমন কোনো কথা নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকার এখন সেই চীনেরই অনুগ্রহ প্রার্থী। আওয়ামী লীগ চিন্তাই করতে পারে না যে, জনগণ তাদের বিরোধিতা করতে পারে। এটা তাদের একটা দেউলিয়াপনারই দৃষ্টান্ত। যে জনগণ তাদের বিরোধিতা করছে, তাদের কথা তারা চিন্তা না করছে না। আওয়ামী লীগ আসলে যারা আন্দোলনে তেমন ভূমিকা পালন করতে পারেনি, সেই বিএনপি ও জামায়াতের ঘাড়ে সব দোষ চাপাতে চাইছে। সরকার জনগণকে সামাল দিতে পারছে না বলে অন্যদিকে দৃষ্টি সরাতে চাইছে। তার জন্য যারা আসল না, তাদের নিয়ে হইচই করছে। এটা করে তারা পার পাবে না। এটা ঠিক যে, এ মুহূর্তে তারা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এনেছে; কিন্তু পরিস্থিতি যে এমন থাকবে, তার বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই। দেশের জনগণের বিভিন্ন অংশ যেভাবে সরকারের বিরোধিতা করছে, তাতে করে নতুন করে আন্দোলন ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আক্রান্ত হচ্ছে। এ রকম আক্রমণাত্মক আন্দোলন আগে কখনও দেখা যায়নি। এই আন্দোলনের পরিণতি কোথায় দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সমকাল : বর্তমানে তো একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থাও তৈরি হয়েছে। এর রাজনৈতিক সমাধান কী? বাংলাদেশের মানুষের সামনে কী আছে?

বদরুদ্দীন উমর: সরকার সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এমনকি নিজস্ব লোকেরাও তাদের ছেড়ে যাচ্ছে। কোনো পক্ষেই তাদের কোনো সমর্থন নেই। তাদের পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। দলীয় ‍সুবিধাভোগী এবং ১৪ দলের নেতারা ছাড়া তাদের সমর্থন করার লোক খুব কম। দেশের বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সকল রকম গণসংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের বিরোধিতা করছে। এমন অবস্থায় জনগণের জন্য বা দেশের জন্য কার্যকর কিছু করার অবস্থা সরকার হারিয়ে ফেলেছে। গণঅভ্যুত্থানে আওয়াজ উঠেছে, এই সরকারের অপসারণ। জনগণও সেটাই চায়। তার পরে নতুন একটা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই লক্ষ্যের জন্য সংগ্রাম করার লক্ষ্যেই জনগণের আন্দোলনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

samakal