দাবদাহকালে ঝিমোচ্ছে রাজনীতিও

দাবদাহকালে ঝিমোচ্ছে রাজনীতিও

আবহাওয়া খুব গরম। চারদিকে দাবদাহ। এটা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই এ সময়ে গরম পড়ে। আগের বছরের গরমের কথা আমরা পরের বছর ভুলে যাই। প্রায় শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে…।’ তখনই প্রকৃতি অগ্নিবাণ বর্ষণ করত।

তবে সম্ভবত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই প্রচণ্ড উষ্ণতা, তার সঙ্গে বৃষ্টিহীন দিনগুলো মিলে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করেছে। এ অবস্থার প্রভাব রাজনীতিতে পড়েছে বলে মনে হয়। কারণ, রাজনীতির মাঠও প্রকৃতির উত্তাপের কাছে ম্লান হয়ে গেছে।

এখন রাজনীতিটা বেশ ঝিমোচ্ছে বলে মনে হয়। চৈত্রের বা বৈশাখের অলস দুপুরে আমরা গাছের নিচে বসে বসে যেমন জিরোই, ঝিমোই, এখন রাজনীতির অবস্থাটা অনেকটা সে রকম।

এর মধ্যে বিএনপি একটা কর্মসূচি দিয়েছিল। তারা ২৬ এপ্রিল নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। আর যায় কোথায়? আওয়ামী লীগ সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা কর্মসূচি দিল যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তারাও একটা সমাবেশ করবে। এখানে আমরা অর্থনীতির সেই ডুয়োপলির তত্ত্ব প্রয়োগ করতে পারি।

এই তত্ত্বে দেখা যায় যে একটি শিল্পে যদি দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকে, একটি প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠান কী কৌশল নেয়, তার জন্য অপেক্ষা করে তার নিজের কৌশল সাজায়। সেটা দেখে অন্য প্রতিষ্ঠান আবার তার কৌশল পাল্টায়। এভাবে পরস্পর পরস্পরের কৌশলকে ব্যবহার করে।

আমাদের রাজনীতিতে ডুয়োপলির তত্ত্ব বেশ স্পষ্ট। এখানে রাজনীতিকে যদি শিল্পের মর্যাদা দেওয়া যায়, তাহলে বলব যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের কৌশলের দিকে নজর রাখে এবং সে অনুযায়ী নিজেদের রণকৌশল সাজায়। কখনো দেখা যায় আওয়ামী লীগের কৌশল দিয়ে বিএনপি প্রভাবিত হয়; কখনো দেখা যায় বিএনপির কৌশল দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রভাবিত হয়।

কিন্তু বছর দুয়েক ধরে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ অনেক ক্ষেত্রেই বিএনপিকে অনুসরণ করছে। বিএনপি কোথাও কোনো সমাবেশ বা শোভাযাত্রার কর্মসূচি দিলে আওয়ামী লীগ তার পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। বিএনপি মাঠে না থাকলে হয়তো আওয়ামী লীগকে জোর করে মাঠে নামতে হতো না। এদিক দিয়ে বলা যায়, আওয়ামী লীগকে অনেক ক্ষেত্রেই সক্রিয় রেখেছে বিএনপি।

২৬ এপ্রিলের কর্মসূচিটাও সে রকম ছিল। কিন্তু আবহাওয়া এত গরম, প্রকৃতি এত প্রতিকূল যে বিএনপি এক বিবৃতি দিয়ে তাদের কর্মসূচি স্থগিত করল। সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগও তাদের কর্মসূচি স্থগিত করার ঘোষণা দিল। শহরের মানুষ কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কেননা, রাজনৈতিক সমাবেশ মানেই হচ্ছে যানজট, অসহনীয় দুর্ভোগ। বিএনপি-আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ মানে শহর অচল হয়ে যাওয়া, জনজীবন স্থবির হয়ে পড়া।

অনেকে বলেন, এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস। কিন্তু এপ্রিল আমাদের অনেক কাজেও আসে। এখন আমরা বলছি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। এর কারণে দাবদাহ বাড়ছে, বৃষ্টি অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছর চৈত্র-বৈশাখ মাসে আমাদের এখানে আবহাওয়া কমবেশি এমনই থাকে। কৃষকেরা এ সময়ে ধান শুকান। উষ্ণ আবহাওয়া তাঁদের জন্য উপকারী।

দাবদাহকালে রাজনীতি তো থেমে নেই। এখন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। এই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন তাঁরা করবেন না। এতে অনেকে আশা করেছিলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনেক বেশি জমজমাট হবে। যিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বা যাঁর সবচেয়ে বেশি শক্তি-ক্ষমতা আছে, তিনিই জিতে আসবেন।

মনে হয়েছিল, বিএনপির লোকেরা ব্যক্তিগতভাবে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সেটা বিএনপির রাজনীতির জন্য কিছুটা মোড় পরিবর্তনকারী হতে পারত। কিন্তু শেষমেশ বিএনপি বলল যে তারা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাবে না। দলগতভাবে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের যদি সেটা প্রত্যাহার করে নিতে বলা হয়, তাহলে বলা যায়, বিএনপি হার্ডলাইনে রয়েছে।

কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির অনেক নেতা এই নির্বাচনের ব্যাপারে উৎসাহী। অনেকেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁদের কাছে অগ্রাধিকারটা অন্য রকম। স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব-প্রতিপত্তিটা বজায় রাখতে হলে নির্বাচনটা একটা ভালো হাতিয়ার।

স্থানীয় সরকারে নির্বাচনে জিতে আসা মানেই হলো স্থানীয় সরকারে কর্তৃত্ব পাওয়া। স্থানীয় সরকার অনেকটা অর্থনৈতিক শক্তিরও উৎস। কারণ, এখন স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে প্রচুর সরকারি বিনিয়োগ আসে। স্থানীয় সরকারে যাঁরা নির্বাচিত হন, তাঁদের অনেকেই দলের কাজে সেই অর্থ ব্যয় করেন।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন কিংবা তাদের দলের লোকদের প্রার্থী হওয়া থেকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে বিএনপি কী অর্জন করতে চায়, সেটা বোধগম্য নয়। ২০১৪ সালের পর থেকে বিএনপি তো লাগাতারভাবে নির্বাচন বর্জন করেছে। তাহলে বিএনপি এখন কী করবে, সেটা একটা প্রশ্ন।

বিএনপি তো শুধু নেতাদের দল নয়; তাদের প্রচুর কর্মী ও সমর্থক আছে। সাধারণ মানুষ যাঁরা বিএনপির সমর্থক, তাঁরা তাহলে কী করবেন? তাঁরা কি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন, নাকি অন্য প্রার্থীর হয়ে কাজ করবেন।

বিএনপিকে আবেগতাড়িত হয়ে একটা সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেয়ে যৌক্তিকভাবে বিষয়টাকে তাদের কর্মী-সমর্থকদের সামনে হাজির করা গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি এখনো যৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্ত হাজির করতে পারেনি।

আওয়ামী লীগও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিপাকে আছে। আওয়ামী লীগ এমন একটি দল, তারা যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদের স্বজনপ্রীতি বা আত্মীয়তোষণ খুব দৃষ্টিকটুভাবেই নজরে আসে। সেটা আমরা ১৯৭২ সাল থেকেই দেখে আসছি।

এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে একটা ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, যাঁরা মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, তাঁরা যেন তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে না দেন।

কিন্তু অনেক জায়গায় এই নির্দেশ না মেনে তাঁরা প্রার্থী হয়েছেন। আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী না করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে ব্যাপারে তারা নিজেরা কতটা আন্তরিক, সে প্রশ্ন রয়েছে। যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যাবে না, সেই সিদ্ধান্ত তারা নেয় কেন?

কয়েক জায়গায় সংসদ সদস্য-মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও অনেক জায়গায় তাঁরা সেটা করেননি। যাঁরা প্রত্যাহার করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে দল কি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে?

অতীতেও দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কারণে অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তাঁরা আবার জিততে পারলে আওয়ামী লীগ তাঁদের মহাসমারোহে বরণ করে নিয়েছে। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বললেও বাস্তবে সে রকম উদাহরণ দেখা যায় না। আর এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তো আওয়ামী স্বতন্ত্র লীগ।

তবে অসহনীয় গরমের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন। তারা বলছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশে হত্যা, নির্যাতন, গুম, খুন—এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার ছিল, সেসব ক্ষেত্রে তারা লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখেনি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে তারা মনে করে, ব্যাপারটি বাংলাদেশে ক্ষুণ্ন হচ্ছিল, এখনো হচ্ছে।

দুঃসহ গরমের এই সময়ে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষি একটা বেহাল অবস্থার মধ্যে আছে। এর মধ্যে মাথা পাগল করে দেওয়া আরেকটা খবর হলো, এ অর্থবছরের ৯ মাসে আমাদের ঋণের কিস্তির সঙ্গে সুদ পরিশোধের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আমরা অনেক ক্ষেত্রে ঋণ করে ঘি খাওয়ার যে অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক কৌশল নিয়েছি, তার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। তাদের সম্ভাবনাটুকু বন্ধক গেছে। অথচ এটা নিয়ে আমরা কেউ ভাবছি না।

● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

prothom alo