নিজস্ব প্রতিবেদক
দলীয় সরকারের অধিনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় উল্লেখ করে সুজনের আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সব ক্ষমতা থাকলেও তারা নিরপেক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি বিবেক শূন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যে কারণে নির্বাচন নিয়ে জনগণের আগ্রহ শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে।
রোববার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন’ শীর্ষক একটি অনলাইন গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বৈঠকে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে কয়েকটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে। দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সময়ে বহু অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আমাদের নির্বাচন কমিশন ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার। অনেকগুলো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তারা তদন্ত করেছে বলেও আমরা শুনিনি। অবশ্য এটা সত্য যে, সরকার ও রাজনৈতিক দল, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল না চাইলে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নূরুল হুদা কমিশনের সব ক্ষমতা থাকলেও তারা নিরপেক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের অসততা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে, তারা ভোট দিতে চাইলেও ভোট দিতে পারবে না। আর ভোট দিলেও তারা ‘ফলাফল’ প্রভাবিত করতে পারবেন না। যারা জয়ী হওয়ার তারাই জয়ী হবেন। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফল বহুলাংশে বানোয়াট। আমাদের নির্বাচনি ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে ফেলেছে। এছাড়া, আমাদের রাজনীতি বহুলাংশে বিরোধী দল শূন্য হয়ে পড়েছে, যার দায় অবশ্য আমাদের প্রধান বিরোধী দলও এড়াতে পারে না। ফলে বহু নাগরিকের মধ্যে আজ চরম অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।’’
সূচনা বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রকৃত ধারণার সঙ্গে আমাদের চারদিকে যে অবস্থা দেখছি, তার কোনও মিল নেই। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। গণতন্ত্র, নির্বাচন এসব বিষয় ক্রমাগত কল্পনার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।’
সুজনের নির্বাহী সদস্য এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের শক্তি হলো আদালত। কিন্তু আমরা আদালতকে কমিশনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে দেখিনি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনাররা একটা আইনের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। তাই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়ন করে যাতে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, সেদিকে আমাদের জোর দিতে হবে।’
আরেক নির্বাহী সদস্য আবু সাঈদ খান বলেন, ‘এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ এবং নির্বাচনি আইন পরিবর্তন করে এলাকাভিত্তিক নির্বাচনি ব্যবস্থার পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, একটা মিশ্র নির্বাচনি ব্যবস্থাতে যাওয়া।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘নির্বাচন, গণতন্ত্র এসব এখন কবি গান, ঘেঁটু গানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র নেই, সেখানে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি বিবেক শূন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের বিবেক শূন্যতার কারণে নির্বাচন নিয়ে জনগণের আগ্রহ শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে।’
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘কমিশন, প্রশাসন দলীয় অঙ্গ সংগঠনের পরিণত হয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা আবার ভালো মতো কাজ দায়িত্ব পালন করেছে। আমাদেরকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের কথা জোরে শোরে বলতে হবে।’
সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন— যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ, বিচারপতি এম এ মতিন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ।