ইকতেদার আহমেদ : বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বহাল থাকাকালীন ১৯৭৩ সালে দলীয় সরকারের অধীন প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে বিজয় অর্জন করে। নির্বাচনটি সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী অনুষ্ঠিত হয় এবং সে সময়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। সে নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী দলীয় পরিচয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি। এর ফলে এ দু’টি দলের সামগ্রিক ভোট তৎকালীন বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) পক্ষে যায়। ওই নির্বাচনে ভোটগ্রহণ সমাপ্ত হওয়ার পর ফল ঘোষণার কাজ শুরু হলে দেখা যায় ১০০-এর কাছাকাছি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সাথে জাসদের প্রার্থীরা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ এবং আওয়ামী লীগের অনেক ডাকসাইটে প্রার্থী যেমন- খন্দকার মোশতাক আহমদ ধরাশায়ী। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নবগঠিত দল জাসদের কাছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন হারানো সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আওয়ামী লীগের জন্য বিব্রতকর ও গ্লানিময় ছিল। আর তাই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে জাসদের অনেক নিশ্চিত বিজয়ী প্রার্থীকে পরাজয়ের ভাগ্যবরণে বাধ্য করা হয়।
সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা জিয়াউর রহমান দুঃখজনকভাবে নিহত হওয়া-পরবর্তী তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এক বছরের মাথায় সেনাপ্রধান এরশাদের নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারায়। এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার অধীন দু’টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উভয় নির্বাচন তৎকালীন দেশের প্রধান দু’টি বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বর্জনের কথা বলে এলেও হঠাৎ আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে এরশাদের অধীন আওয়ামী লীগ প্রথমোক্ত নির্বাচনটিতে অংশগ্রহণ করে। সে নির্বাচনটিতে ফল ঘোষণা শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে- এমন চিত্র ফুটে উঠলে ফল ঘোষণার মাঝপথে এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনকে দেয়া হয়। এরশাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনা মোতাবেক যে ফল প্রস্তুত করা হয় তাতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা এক শ’র ঊর্ধ্বে নয়। অপর দিকে, এরশাদের দল জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা অপ্রত্যাশিতভাবে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি। এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ ব্যতীত অপর কোনো বিরোধী দল অংশগ্রহণ করেনি। এ নির্বাচনেও এরশাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী তার দল ও জাসদের মধ্যে আসন বণ্টন করা হয়। চতুর্থ সংসদে রব বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেন।
ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত উপরোক্ত চারটি সংসদের কোনোটি সংবিধান নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। এ চারটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত না হলে অথবা প্রকৃত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীন অনুষ্ঠিত হলে ফল যে ভিন্নতর হতো এ বিষয়ে তৎকালীন বিরোধী দলগুলোসহ দেশবাসীর মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই।
তিন জোটের রূপরেখায় পরিচালিত আন্দোলনে সেনাবাহিনী এরশাদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে অনেকটা বাধ্য হয়ে তাকে রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে দেয়াসহ সংসদ ভেঙে দিতে হয়। কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। সে নির্বাচনটির ফল এ দেশের সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে নির্ধারিত হয়। যাই হোক, বিজিত দল এ ফলকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। পঞ্চম সংসদে দেশের বড় দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং অপর দল জামায়াতে ইসলামীর সম্মিলিত প্রয়াসে ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার হতে পুনঃসংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করা হয় যা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে।
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী পঞ্চম সংসদ থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে পদত্যাগ করলে নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে সে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনটি ভোটারবিহীন ও একতরফা ছিল। সে সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পরিচালিত আন্দোলনে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ষষ্ঠ সংসদের মাধ্যমে বিরোধী দলের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে বিএনপি যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল তাতে এ দেশের জনগণ অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছিল যে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেশ ও জাতিকে আর কখনো নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে না। কিন্তু এ ব্যবস্থার অধীন অনুষ্ঠিত প্রথম দু’টি নির্বাচন-পরবর্তী যখন নিজ মতাদর্শের লোককে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার মানসে সংবিধান সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়সসীমা দু’বছর বাড়িয়ে দেয়া হয় তখন ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রশ্নে জটিলতা দেখা দেয়। সে সময় দু’টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল। এর কোনোটি সাংবিধানিক বিধানাবলি অনুসরণপূর্বক সঠিকভাবে গঠন করা হয়নি।
নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মতো বিপুল বিজয় পায়। অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হলেও এ দু’টি নির্বাচনে এক দলের বিপুল বিজয় অপর দল মেনে নিতে পারেনি। উভয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা বিজিত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিএনপি যেমন সংসদে একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিল পাস করে অনুরূপ আওয়ামী লীগ নবম সংসদে একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ সাধন-পরবর্তী দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় তাদের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় এটি প্রতিষ্ঠিত করতে সংসদ সদস্যের তিনটি উপনির্বাচন ও পাঁচটি পৌরসভা নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করে। এতে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে- এ বিষয়ে বিএনপির আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হয়। কিন্তু আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ দশম সংসদ নির্বাচন একতরফা ও ভোটারবিহীনভাবে অনুষ্ঠিত করে। নির্বাচনটি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের চেয়ে বেশি ত্রুটিপূর্ণ ও কলুষিত ছিল। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে যে মাত্রায় প্রাণ ও সম্পদের হানি হয়েছিল এ নির্বাচনটির আগে ও পরে উভয়টি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনকে অতিক্রম করেছিল।
দশম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, বিভাজিত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং ২৩৫টি পৌরসভা নির্বাচন ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপিতে ভরপুর ছিল। দশম সংসদ নির্বাচনসহ তিনটি নির্বাচনে দলীয় সরকারের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী বিজয় নির্ধারণ করা হয়।
দশম সংসদ নির্বাচনের মতো একাদশ সংসদ নির্বাচনটিও সংসদ বহাল থাকাবস্থায় দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান-পূর্ববর্তী দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে আশ্বস্ত করা হয় যে, সমসুযোগ সংবলিত মাঠে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছেন নজিরবিহীনভাবে আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণের পূর্ববর্তী রাতে প্রশাসন, পুলিশ ও দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় ব্যালটবাক্স পূর্ণ করে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত করা হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনটিও পূর্বসূরি নির্বাচন কমিশনের মতো ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে।
আমাদের নির্বাচন কমিশন নামক সাংবিধানিক যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, এটিতে দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যাদের ঠাঁই হয়েছে তারা সবাই ব্যক্তিত্বহীন এবং নীতি ও নৈতিকতা-বিবর্জিত। ক্ষমতাসীন দল ব্যতীত দেশের অপর কারো কাছে তাদের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা নেই।
আমাদের দেশে অতীতে বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী যে তিনটি দল রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেছে এদের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচন দ্বারা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে প্রমাণিত হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। এখন যেরূপ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় বিএনপি তাদের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনাগ্রহী, অনুরূপ এটি শতভাগ নিশ্চিত যে বিএনপি বা অপর কোনো দল ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী হবে না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তা ভারত ও পাকিস্তানের জন্য ঈর্ষার বিষয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সরকার পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা গেলে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান হবে ভারত ও পাকিস্তানের অগ্রে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ভারতের সেভেন সিস্টার্সসহ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কেন্দ্রের প্রতি আস্থার হানি ঘটাবে এ বিশ্বাসে দিল্লি সবসময় চায় এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলটি যেন তাদের অনুগামী হয়।
বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র ব্যাহত হওয়ার কারণে মুক্তি তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করলেও আজ দুঃখজনকভাবে এটি সত্যি যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র দলীয় সরকারের আকাক্সক্ষার কাছে বন্দী। এ দেশের কোনো দলীয় সরকার জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে সঠিক মর্যাদা দিতে পারেনি। আর আগামীতে যে পারবে না, এ বিষয়ে দেশবাসীর মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। আর তাই আমাদের স্থায়ীভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন একটি ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে যেকোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় কোনো ধরনের সহিংস পরিস্থিতি অহেতুক দেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক