
অস্থির পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। অস্থিরতা তৈরি করে বৃহত্তর ফায়দা লুটতে বিভিন্ন স্থানে দলটির বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠকের তথ্য পাওয়া গেছে।
সাবেক কয়েকজন আমলা আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন। রাজধানীর একাধিক অভিজাত ক্লাব, শপিং সেন্টার, সরকারি কোয়ার্টারসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি বৈঠকের তথ্য পেয়েছে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থা। নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে আওয়ামী সুবিধাভোগী ও মুজিববাদী কর্মকর্তারা সময়মতো সহযোগিতার জন্যে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। মাঠের পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল হলে স্যাবোটাজ করা সহজ হবে বলে সুযোগের অপেক্ষায় এসব কর্মকর্তা।
সূত্র জানিয়েছে, গত ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মালিবাগের ফরচুন শপিং সেন্টারে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা গোপন বৈঠকে মিলিত হন। মার্কেটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতাদের চিহ্নিত করে নজরদারি করা হচ্ছে। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে উত্তরার পার্শ্ববর্তী আলোচিত একটি অভিজাত ক্লাবে নিয়মিত বৈঠক করে আসছেন ফ্যাসিবাদের দোসররা। ক্লাবটিতে সাধারণত সন্ধ্যার পর যাতায়াত করে থাকেন আওয়ামী ষড়যন্ত্রকারীরা। সেখানে যাতায়াতে নদীপথও ব্যবহার করা যায় বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে চলা সহজ। আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি সাবেক কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ওই ক্লাবে যাতায়াত করেন। সম্প্রতি অভিজাত এলাকার প্রায় সবকটি ক্লাবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকার ধনকুবের সাবেক একজন এমপির ছেলের (বর্তমানে কারাগারে) স্ত্রী রাশিয়ান নাগরিককেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ওই বিদেশিনীর বাসায় ফ্যাসিবাদের দোসররা বৈঠক করে আসছিলেন বেশ কিছুদিন থেকেই। কয়েকটি এনজিওর কর্মকর্তাসহ পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থাকা ব্যক্তি আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার তথ্য পেয়েছেন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কাজে লাগানো হচ্ছে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশি নাগরিকদের। ইতোমধ্যে ওই বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার তোড়জোড় শুর হয়েছে।
বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করা বিদেশি নাগরিকদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা গত তিন মাস আগে লাপাত্তা হয়ে যান। অনেকের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কারো কারো ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে ৫৭৩ জন বিদেশি অবৈধভাবে বাস করছেন বাংলাদেশে। এর মধ্যে ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া রয়েছেন ২৪৩ জন এবং শুধু ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া বিদেশির সংখ্যা ২১৭ জন। পার্শ্ববর্তী একটি দেশের উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক নাগরিকের ব্যাপারে তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে। সাম্প্রতিক অস্থিরতার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক ওই এমপির বিদেশি স্ত্রীর সঙ্গে এসব বিদেশি নাগরিকদের কারা কারা যোগাযোগ করছেনÑতাদের নজরদারিতে আনা হচ্ছে।
এদিকে গত ২৩ আগস্ট ডিএমপি কমিশনারের আমন্ত্রণে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিএনপির মহানগর উত্তর কমিটির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের খুনি ক্যাডাররা এখনো পাড়া-মহল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তাদের গ্রেপ্তার না করায় উদ্বেগ বাড়ছে বলে তিনি সভায় তুলে ধরেন।
সূত্র আরো জানায়, ঢাকায় নাশকতার নেতৃত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিয়মিত সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন। কলকাতার সল্ট লেকে অভিজাত ফ্ল্যাটে পলাতক আওয়ামী নেতা, পুলিশ ও আর্মি অফিসাররা কামালকে সহযোগিতা করছেন। কামালের নির্বাচনী এলাকার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের একজন মহিলা কাউন্সিলর আগারগাঁওয়ের একটি সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে গত ৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাতে গোপন বৈঠক করে।
অন্যদের মধ্যে তেজগাঁও থানা ও ওয়ার্ডের দুজন নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তেজগাঁও থানার তেজকুনিপাড়া এলাকার (স্থানীয় নাম নামার মসজিদ) তেজকুনিপাড়া জামে মসজিদের উত্তর পাশের দেওয়ালঘেঁষে পশ্চিম দিকে সরু গলিতে এ দুই নেতার বাসা। একজন থানার নেতা, আরেকজন ওয়ার্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। অনুকূল পরিবেশের একজন নেতার আশ্রয়ে এরা এলাকায় বীরদর্পে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। আর রাতের আঁধারে গোপন বৈঠক করে। কামালের নির্দেশনা মতো টাকা বিতরণ করা হয়।
জানা গেছে, সম্প্রতি কলকাতায় আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করে সেখান থেকে দিকনির্দেশনা নিয়ে আসেন বিএনপির নাম ভাঙানো এক নেতা। তেজগাঁও থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার, কানাডায় পালিয়ে যাওয়া শামীম হাসানের সব ব্যবসা দেখাশোনা ও বাড়ি ভাড়া কালেকশন করেন তিনি। ঢাকার পাশে ধামরাই এলাকার কালামপুর এলাকায় আত্মগোপনে থাকা থানা কমিটির নেতা আলমগীর হোসেন লাতু, আত্মগোপনে থাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হক জিল্লু, সাবেক মহিলা সংরক্ষিত মহিলা আসনের কমিশনার মিতাসহ কামালের ঘনিষ্ঠদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে এসেছেন ওই নেতা। এসব নেতার গতিবিধি মনিটরিং করা হচ্ছে বলে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান।
সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের শখানেক নেতাকর্মী মিছিল করে। বেলা সোয়া ৩টার দিকে ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডে রাপা প্লাজাসংলগ্ন রাস্তা থেকে শংকরের বাংলাদেশ আই হসপিটালের সামনের সড়ক পর্যন্ত মিছিল করতে দেখা যায় তাদের। এ সময় তারা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। সপ্তাহখানেক আগে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। ডিএমপি সূত্র জানিয়েছে, ধানমন্ডির মিছিলে অংশ নেওয়া ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের এক ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে।
ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী আমার দেশকে বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারে কোনো ছাড় নেই। অভিযান আরো জোরদার করা হবে।
বলা হচ্ছে, গত ২৯ আগস্ট গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর সেনা-পুলিশের লাঠিচার্জের আগে কাকরাইলে জাতীয় পার্টির অফিসের সামনে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের ছদ্মাবরণে আওয়ামী ক্যাডাররা পরিকল্পিতভাবে গণঅধিকার পরিষদের মিছিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এর সূত্র ধরে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ দলটির প্রায় ৫০ জনকে পিটিয়ে জখম করা হয়। সেখানে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এর আগে গত ২৭ আগস্ট প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিকে ঘিরে ছাত্রলীগ ঢুকেছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানতে পারেন। কর্মসূচি ছিল মূলত শান্তিপূর্ণ লংমার্চ টু ঢাকা। অর্থাৎ শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি। কিন্তু দুপুর সাড়ে ১২টার পর তারা ঘোষণা দেয় দুপুর ১টার মধ্যে দাবি মেনে না নিলে পরে সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা করবে।
বেলা ১টার পরে তারা যথারীতি সচিবালয়ে যাত্রার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কয়েকজন ভিন্নমত জানায়, তখন মাইকে বলা হলো এখন নামাজের বিরতি। এ সময় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও তাদের সঙ্গে কথা বলছিল। কিন্তু আনুমানিক দেড়টার দিকে হঠাৎ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ওই কয়েকজন মাইকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে রওনা হওয়ার ঘোষণা দেয়। ওই কয়েকজনকে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দ্রুতই তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে বলে জানা গেছে। এদের গ্রেপ্তার করলে পেছনের অপরাধীদের ধরা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ১৫ আগস্ট শুক্রবার মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর সীমান্তে ৫১ হাজার ডলারসহ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) একজন আটক করার পর হুন্ডির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে টাকা আসার বিষয়ে নতুন তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এক্ষেত্রে পুরান ঢাকার কয়েকজন স্বর্ণব্যবসায়ীকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ভারত থেকে কীভাবে টাকা আসে এবং ভারতে কীভাবে ডলার পাচার হচ্ছে, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।