নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ মিলছে না কারখানায়। ডলার সংকটে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খুলতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন উদ্যোক্তারা। পর্যাপ্ত ডলার না মেলায় আমদানিও করা যাচ্ছে না প্রয়োজনমতো। অন্যদিকে আমদানি-রফতানির সরবরাহ চেইনে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে লোহিত সাগরের চলমান সংঘাত। অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ক্রেতাদেশগুলোর ভোক্তাদের ক্রয়াভ্যাসেও এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। ফলে দেশগুলো থেকে ক্রয়াদেশও কমেছে। সব মিলিয়ে দেশের তৈরি পোশাক খাতের কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার বড় একটি অংশ এখন অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে দেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা অভিযোগ তুলেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের কারখানার মোট সক্ষমতার অর্ধেকেরও বেশি অব্যবহৃত অবস্থায় বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। গতকাল প্রকাশিত এক জরিপেও অর্ধশতাধিক পোশাক কারখানার মালিক জানিয়েছেন, এপ্রিল পর্যন্ত বছরের প্রথম চার মাস তাদের কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশ বসিয়ে রাখতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, শিল্পটি এখন অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে শিল্পটির ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনার আয়োজন করছে পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সংগঠন বিজিএমইএর নির্বাচনী জোট ‘ফোরাম’। জোটটির পক্ষ থেকে ডিসেম্বরের শেষ দিকে এক জরিপের আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন ৬৬ গার্মেন্টস মালিক। জরিপের ফলাফল গতকাল ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত এক ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়।
জরিপে উঠে আসা উৎপাদন সক্ষমতার বড় একটি অংশ অব্যবহৃত থাকার তথ্যের সঙ্গে একমত পোষণ করছেন বিজিএমইএর বর্তমান নেতৃত্বে থাকা সম্মিলিত পরিষদের সমর্থকরাও। তারা বলছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির অপ্রতুল ক্রয়াদেশ ও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে জ্বালানি সংকটে উৎপাদন সক্ষমতার উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আবার এ পরিস্থিতি থেকে কবে উত্তরণ সম্ভব হবে, সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না।
বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নতুন ক্রয়াদেশ অনেক কম, আবার গ্যাসের কারণেও উৎপাদন সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। শিল্পগুলোর অন্তত ৩৫ শতাংশ সক্ষমতা খালি আছে। সার্বিক পরিস্থিতি এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। যুদ্ধ না কমলে সুনির্দিষ্ট করে কোনো আভাসও পাওয়া যাবে না। ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ ছাড়ছেন না। সব মিলিয়ে গার্মেন্ট প্রস্তুতকারক কারখানাগুলো এখন সর্বোচ্চ ৬৫-৭০ শতাংশ সক্ষমতায় চলমান রয়েছে।’
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ২০২৩ সালে সংশ্লিষ্ট মালিকের গার্মেন্ট কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার কতটা অব্যবহৃত ছিল। এতে উঠে আসে, গত বছর পোশাক কারখানাগুলোকে উৎপাদন সক্ষমতা অব্যবহৃত রাখতে হয়েছে গড়ে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
এছাড়া এতে অংশগ্রহণকারীদের ক্রয়াদেশের ভিত্তিতে এপ্রিল পর্যন্ত পরবর্তী চার মাসে কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার কত শতাংশ সচল রাখা যাবে বলে জানতে চাওয়া হয়। উদ্যোক্তাদের উত্তরের ভিত্তিতে হিসাব করে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ক্রয়াদেশের ভিত্তিতে কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৬২ শতাংশ ব্যবহার করা যাবে। সে অনুযায়ী ওই সময় পর্যন্ত অব্যবহৃত রাখতে হবে উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ শতাংশের কাছাকাছি।
এছাড়া জরিপে শিল্প মালিকরা নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের পর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্রেতার ভূমিকা, কাস্টমস ও বন্ড সংক্রান্ত ব্যয় ইত্যাদি বিষয়সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতার কথাও জানিয়েছেন।
তৈরি পোশাকের ক্রেতারাও এখন তাদের ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য কমিয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। এতে অংশ নেয়া কারখানা মালিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল গত এক বছরে গড়ে পণ্যের এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) মূল্য কত শতাংশ কমেছে। ফলাফল অনুযায়ী এক বছরে গড়ে রফতানীকৃত পণ্যের এফওবি মূল্য কমেছে ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ।
চলতি মাস থেকেই বাস্তবায়ন হচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির নতুন কাঠামো। মজুরি বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ক্রেতারা পণ্যের দাম কত শতাংশ বাড়িয়েছেন—এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল জরিপে। এতে অংশ নেয়া ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ কারখানা মালিক জানিয়েছেন যে ক্রেতারা পণ্যের মূল্য বাড়ায়নি। কাস্টমস ও বন্ড খরচের বিষয়ে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে এ বাবদ তাদের ব্যয় আগের বছরের তুলনায় গড়ে ৪৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়েছে।
পোশাক শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের এখন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিল ও লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানায় ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে। এমনকি পরিবহনের ক্ষেত্রেও জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ কারখানাগুলোয় সরবরাহকৃত গ্যাসের মূল্য ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে উদ্যোক্তাদের ভোগান্তিও দিনে দিনে বেড়েছে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি ও নির্বাচনী জোট ফোরামের প্যানেল লিডার ফয়সাল সামাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উৎপাদন সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকার একটি বড় কারণ হলো বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট। গত ছয় থেকে আট মাস ধরে পশ্চিমা ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি কারখানায়ই এখন ক্রয়াদেশ কম। পাশাপাশি প্রতিযোগী দেশগুলো যেমন ভারত-পাকিস্তান-চীনের পোশাক শিল্প মালিকরা এখন তুলনামূলক কম মূল্যে ক্রয়াদেশ নিচ্ছেন। আমাদের কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতায় এখন এসবেরই প্রভাব দেখা যাচ্ছে।’
সূত্র : বনিক বার্তা