- মুহিউদ্দিন আতামান
- ০৫ জুন ২০২৩, ২০:২৩, আপডেট: ০৬ জুন ২০২৩, ০৫:৫২
গুরুতর সমস্যা ছাড়াই আরেকটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে তুরস্ক। গত ২৮ মে দেশটিতে রানঅফ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তুরস্কের প্রায় ৮৫ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দুই প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেয়। তাদের একজন পিপলস অ্যালায়েন্সের প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এবং অপরজন তার প্রতিপক্ষ, বিরোধী জাতীয় জোটের প্রার্থী কামাল কিলিচদারোগলু।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান ৫২.১৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিচদারোগলু পেয়েছেন ৪৭.৮২ শতাংশ। এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ১০টিরও বেশি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন- যার মধ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, পার্লামেন্ট নির্বাচন, স্থানীয় নির্বাচন ও গণভোট। এটি আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে একটি রেকর্ড-উচ্চ সংখ্যা, যা এরদোগানকে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রনায়ক বানিয়েছে।
অবাধ ও সুষ্ঠু তুর্কি নির্বাচনের এই অসামান্য রেকর্ড সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্ব এখনো তুর্কি নির্বাচনের ফলাফলকে খাটো করে দেখে। বেশির ভাগ পশ্চিমা রাজনৈতিক অভিনেতা, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া দৃঢ়ভাবে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ‘স্বৈরাচারী নেতা’ বা ‘একনায়ক’ বলে অভিহিত করে চলেছেন। দুর্ভাগ্যবশত, এই ব্যাপকভাবে প্রচার করা ভুল ধারণা তুরস্কের প্রতি তাদের নীতিগুলোকে রূপ দিচ্ছে। প্রায় সব নির্বাচনের আগে পশ্চিমা অভিনেতারা এরদোগানের বিরোধিতার জন্য তাদের সমর্থন জোগাড় করছে।
গত কয়েক মাস ধরে, প্রায় সব নেতৃস্থানীয় পশ্চিমা মিডিয়ায় তুরস্কের নির্বাচন কভার করা হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে কয়েকটি তুর্কি নির্বাচনকে বিশ্বের ২০২৩ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করে এবং তারা এরদোগানের প্রতিদ্ব›দ্বীকে রক্ষা করার জন্য নির্বাচনে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। কুখ্যাত পশ্চিমা মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের প্রায় সব শিরোনাম সরাসরি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার সরকারকে লক্ষ্যবস্তু করে। তা সত্ত্বেও তুর্কি জনগণ পশ্চিমা অভিনেতাদের অবিস্মরণীয় শিক্ষা দিয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্রতিটি নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করেছেন।
পশ্চিমা পক্ষপাত
অসংলগ্ন পাশ্চাত্য, যারা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যতিক্রমবাদে বিশ্বাস করে এবং তুরস্কের ব্যাপারে প্রাচ্যবাদী ধারণার অধিকারী, তারা তাদের অতীতের ভুল থেকে কোনো শিক্ষা নেয় না এবং তারা চায় না কোনো মুসলিম দেশ সুসংহত গণতন্ত্রের একটি অভিজ্ঞতা লাভ করুক। নীতিগতভাবে পশ্চিমারা তাদের দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার প্রদানকারী বা পশ্চিমাবিরোধী রাজনীতিবিদদের জিতে যাওয়া নির্বাচনের কোনো ফলাফলকে স্বীকৃতি দেয় না। যেহেতু প্রেসিডেন্ট এরদোগান পশ্চিমাদের কাছে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সম্পর্ক রাখতে বলছেন, তাই পশ্চিমারা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করে।
উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমারা তুরস্কের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই ২০১৬-এর ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা করেনি। তারা আরো এগিয়ে গেছে, বেশির ভাগ পশ্চিমা সরকার তখন থেকে অভ্যুত্থানকারীদের আতিথ্য ও সুরক্ষা দিচ্ছে। হাস্যকরভাবে, তারা এমনকি পশ্চিমা সরকারের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত সহিংস অ-রাষ্ট্রীয় অভিনেতাদের যেকোনো ধরনের সহায়তা দিয়েছে। অতএব এরদোগানবিরোধী রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিনেতার প্রতি পশ্চিমা সমর্থন বিস্ময়কর নয়। যেহেতু প্রেসিডেন্ট এরদোগান তাদের প্রত্যাশা পূরণ করেন না এবং পশ্চিমাদের সাথে একটি নির্ভরশীল ও শ্রেণিবদ্ধ সম্পর্ককে গ্রহণ করেন না, তাই পশ্চিমা রাজনৈতিক অভিনেতারা প্রত্যেক নির্বাচনের আগে তাদের এরদোগানবিরোধী প্রচারণা পুনরায় শুরু করে।
এই প্রথম পশ্চিমা নেতারা এরদোগানকে অভিনন্দন জানাতে এত দ্রুত কাজ করেছে যে, মনে হচ্ছে তারা প্রধানত তুর্কিবিরোধী থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ও শিক্ষাবিদদের দিয়ে গঠিত তাদের বিপথগামী নীতির জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যেহেতু কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাবিদ, অভিজাত বুদ্ধিজীবী ও তুর্কিবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠনের পলাতক সদস্যরা পশ্চিমে তুর্কিবিরোধী ধারণা গঠন করতে থাকবে, তাই পশ্চিমা সরকারগুলো আঙ্কারার প্রতি বিরোধী নীতি অনুসরণ করতে থাকবে।
যাই হোক, পশ্চিমা রাজনৈতিক অভিনেতাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, এই তুর্কিবিরোধী নীতিগুলো সবই বিপরীতমুখী। তুরস্কের সাথে পশ্চিমাদের দ্বারা অন্যায় আচরণের ফলস্বরূপ তুরস্ক সেই অনুযায়ী তার পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস করবে এবং অ-পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্ক উন্নত করবে। অন্য কথায়, তুর্কি-পশ্চিমা সম্পর্কের ভবিষ্যৎ মূলত তুরস্ক সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তুর্কিবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সাথে তাদের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে।
শিগগিরই বা পরে, পশ্চিমা নেতারা ও সরকারগুলো তুরস্কের গুরুত্ব ও এরদোগানের নেতৃত্বের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেবে। কেননা, তিনি জনগণের ভোট ও জাতীয় ইচ্ছার ভিত্তিতে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার তৈরি করেছেন। বিশ্বের অনেক নেতাও স্বীকার করেন, প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়; বরং তার দেশের স্বার্থে। এ কারণেই, প্রেসিডেন্ট এরদোগানের অন্যতম প্রধান স্লোগান হলো- দেশীয় ও জাতীয় (তুর্কি ভাষায় ‘ইয়েরলি ভে মিলি’) দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ, যা পশ্চিমে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ হিসেবেও ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য আঙ্কারাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। পশ্চিমা রাজনৈতিক অভিনেতারাও প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একজন কার্যকর খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন যা তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রতিনিধিত্ব করে। দেখা যাক সময় কী বলে।
(তুরস্কের গণমাধ্যম ডেইলি সাবাহ থেকে ভাষান্তর লিয়াকত আলী)