- আশরাফুল ইসলাম
- ১৬ জুন ২০২১
গত প্রায় দেড় বছর ধরে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়েছে, কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি করা যাবে না। এ নির্দেশনা বর্ধিত করতে করতে মার্চ পর্যন্ত করা হয়েছে। তবুও গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা ঋণের ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
শিথিলতা আরোপের পরেও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ার কথা নয়। এরপরেও বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন কিছু ঋণ হয়তো খেলাপি ঋণের পূর্ব অবস্থায় ছিল। ওই সব ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংক মামলা করতে পারে, এ জন্য হয়তো খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপজনিত কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এটা তিনি মনে করেন না। পর্যাপ্ত জামানত রেখে নতুন ঋণ বিতরণ করলে এবং বিদ্যমান খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক জোরালো উদ্যোগ নিলে জুন শেষে খেলাপি ঋণ কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান গতকাল নয়া দিগন্তকে এ বিষয়ে জানান, এটা হঠাৎ করে হয়নি, এ আশঙ্কা আমরা আগে থেকেই করেছিলাম যে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিল থাকলেও ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণ নবায়ন করে থাকে। কোনো গ্রাহক যখন কোনো ঋণই পরিশোধ করছেন না এবং তা খেলাপি ঋণের পূর্ব অবস্থায় থাকলে ওই ঋণ আপনা আপনি খেলাপি হয়ে যাবে। তবে এ খেলাপি ঋণ জুন শেষে আরো বেড়ে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। কারণ নতুন ঋণের পরিমাণ তেমন বাড়ছে না, বিপরীতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। আমরা ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারব, কিন্তু গ্রাহক ন্যূনতম ডাউন পেমেন্ট না দিলে ওই ঋণ আমরা নবায়ন করতে পারব না। এভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতায় ঋণ আদায় কার্যক্রম থেমে যায়। এক দিকে করোনার প্রভাবে ব্যবসা বাণিজ্যে খারাপ অবস্থা, অপর দিকে এক শ্রেণীর গ্রাহক ইচ্ছেকৃত ঋণ আদায় না করায় অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। আগে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তাদের অনেকেই ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেন। এতে ঋণ আদায়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। ব্যাংকগুলোতে মোটা দাগে দুই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ থেকে প্রকৃত মুনাফা কমে যায়। অপর দিকে ঋণ আদায় না হলেও সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে ঋণখেলাপি করা যায়নি। এতে এক দিকে ব্যাংকের প্রকৃতপক্ষে পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলেও নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ দেখানো সম্ভব হয়নি। এ সুযোগটি অনেক ব্যাংক নিয়েছে। কারণ খেলাপি ঋণের শ্রেণীভেদে শতভাগ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। কিন্তু যেখানে নীতিমালার কারণে ঋণখেলাপি করা যায়নি, এতে ঋণ আদায় না হলেও খেলাপি ঋণ না বাড়ায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়নি। এতে কিছু কিছু ব্যাংক কৃত্রিম আয় বাড়িয়ে দেখায়। এ কৃত্রিম আয়ের ওপর ভিত্তি করেই সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সরকারের করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ঋণখেলাপি হলে সে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারে না। এমনকি কোনো জাতীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারে না। এ কারণে কারও ঋণ আনাদায়ী থাকলে ব্যবসা চালু রাখার স্বার্থেই তড়িঘড়ি করে অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতেন। আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলেও ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতেন। এভাবে ব্যাংকের ঋণ আদায় বেড়ে যেত। কিন্তু গত বছর জানুয়ারি থেকে প্রথমে জুন মাস পর্যন্ত ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা আরোপ করা হয়। ব্যাংকাররা ধরেই নিয়েছিলেন তারা জুলাই থেকে খেলাপি করতে পারবেন। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে ঋণ আদায়ের শিথিলতা আরো তিন মাস বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ শিথিলতা একপর্যায়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করে। সর্বশেষ তা মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ফলে ব্যাংকগুলো অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে।
এক বছর তিন মাস ঋণ আদায় কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যায়। অন্য দিকে আমানতকারীদের অর্থও শর্তানুযায়ী ফেরত দিতে হয়। এমনি পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো নতুন বিনিয়োগ পারলে বন্ধ করে দেয়। অনেক ব্যাংকই নতুন বিনিয়োগে না গিয়ে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ সীমাবদ্ধ করে ফেলে। পাশাপাশি গত বছরের এপ্রিল থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়া হয়। বলা হয় ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। এক দিকে ঋণ আদায় কমে যাওয়া, অপর দিকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেধে দেয়ায় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার তলানিতে নামিয়ে আনে। সবমিলেই নতুন বিনিয়োগ কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বরে যেখানে ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা, সেখানে মার্চে এসে হয়েছে ১১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বরের ১১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদ বা মুনাফা যুক্ত করলে এমনিতেই ১৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণ বাড়ার কথা। এ কারণে প্রকৃতপক্ষে ঋণ বাড়েনি। আগের ঋণের সাথে তিন মাসের সুদ যুক্ত হওয়ায় ঋণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, যা মোট দুই লাখ সাত হাজার ৭৭১ কোটি টাকার ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা, যা মোট ৮ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। বিদেশী ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হয়েছে দুই হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, যা মোট ৫৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকার ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। আর বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে চার হাজার ৮৬ কোটি টাকা, যা মোট ৩০ হাজার ৫৯২ কোটি টাকার ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ।