২০২৪ সালের ফ্রিডম হাউস রিপোর্টে বাংলাদেশকে একটি ‘আংশিক মুক্ত’ জাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকেও একইভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের মতে বাংলাদেশ আজ একদলীয় রাষ্ট্র। অবশ্য সংসদ (জাতীয় সংসদ) এখনো আছে এবং অন্যান্য দলও আছে। কিন্তু প্রাথমিক বিরোধী দল নিখোঁজ এবং তার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২২৪টি আসন জিতেছিল। অর্থাৎ ৩০০ আসন বিশিষ্ট সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। আগের নির্বাচনে খালেদা জিয়া নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বিরোধী দলের নেতাদের জেলে ঢোকানোসহ সরকারের বিরুদ্ধে অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এটি একটি কারণ যে, নির্বাচিত সরকার থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশকে ‘আংশিক মুক্ত’ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটে লিখেছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কথা বলেছি এবং সংসদ নির্বাচনে ঐতিহাসিক চতুর্থবারের মতো জয়ের জন্য তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি ।
নির্বাচন সফলভাবে পরিচালনার জন্য আমি বাংলাদেশের জনগণকেও অভিনন্দন জানাই।” ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বলেছেন যে, “যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের সাথে এই মতামত শেয়ার করে যে এই নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না এবং আমরা দুঃখিত যে সব দল অংশগ্রহণ করেনি”।
পরের মাসে, ২০২৪ এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে নির্বাচন সংঘটিত হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেইসময় জেলে ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, “আমরা আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়নের সাথে একমত যে, এই নির্বাচনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অযাচিত বিধিনিষেধ ছিলো। আমরা নির্বাচনী সহিংসতা, গণমাধ্যম কর্মীদের উপর হামলা সহ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রয়োগের উপর বিধিনিষেধ এবং ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ পরিষেবাগুলিতে বিধিনিষেধের নিন্দা জানাই। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এই হস্তক্ষেপ বা জালিয়াতির অভিযোগের সম্পূর্ণরূপে তদন্ত করা উচিত।”
পাকিস্তান বাংলাদেশের মতো বিরোধী-মুক্ত গণতন্ত্র হওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। জেলে থাকা ইমরান খান তখনও এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেতে সক্ষম হন। ১৯৭৭ সালে, পাকিস্তানে একটি নির্বাচন হয়েছিল যেখানে ক্ষমতাসীন দল জিতেছিল, এটি এমন একটি সময় যখন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো জনপ্রিয় ছিলেন। তার জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, নির্বাচনটি অবাধ বা সুষ্ঠু নয় বলে দেখা হয়েছিল, বিরোধী দল দুর্বল হলেও রাষ্ট্রের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। সেই সময়ের ঘটনার ফল পাকিস্তান চার দশক ধরে ভুগছে।
যেখানে নির্বাচন কমিশন এবং সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানের কাজ করার স্বাধীনতা থাকে সেখানে গণতন্ত্র বজায় থাকে। এর অর্থ এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার থেকে স্বাধীন। সেখানে বিরোধী দল মনে করে না যে তারা একটি ‘পূর্বনির্ধারিত ম্যাচ’ খেলছে, একটি দলের জন্য ভিন্ন কোনো নিয়ম রয়েছে এবং ম্যাচে যোগদানকারী আম্পায়াররা তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট। এগুলো মৌলিক জিনিস কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এগুলো সঠিকভাবে পালন করা হয় না।
২০১৪ সালে ভারত যেখানে ছিল সেখান থেকে তার অবস্থান বদলেছে । ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচক নাগরিক স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে। ২০১৪ সালে, ভারত ২৭ তম স্থানে ছিল। ২০২০ সালে, ভারতকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল। গত বছর দেশটির র্যাঙ্কিং ছিল ৪১। এটি ছিল নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের ফলাফল এবং মোদির অধীনে ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, যার নীতিগুলো মুসলিম বিরোধী অনুভূতি এবং ধর্মীয় বিবাদকে উস্কে দিয়ে দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সিভিকাস মনিটরের ন্যাশনাল সিভিক স্পেস রেটিংগুলো গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাসোসিয়েশন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করে। ২০১৭ সালে এতে ভারতের রেটিং ছিল ‘অবস্ট্রাক্টেড’ (অবরুদ্ধ) কিন্তু তারপর থেকে এটি ‘রিপ্রেসড’-এ ( অবদমিত ) নেমে এসেছে। ফ্রিডম হাউস বলেছে যে, ‘বিজেপি রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট করার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করেছে’।
ইউনিভার্সিটি অফ গোথেনবার্গের ভি-ডেম রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ‘ভারত গত ১০ বছরে বিশ্বের সমস্ত দেশের মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তনগুলোর মধ্যে একটি প্রত্যক্ষ করেছে। নরেন্দ্র মোদির অধীনে, ভারত একটি গণতন্ত্র হিসাবে তার মর্যাদা হারিয়েছে এবং হাঙ্গেরি ও তুরস্কের মতো দেশগুলির ন্যায় ‘নির্বাচনী স্বৈরাচারের’ সাক্ষী থেকেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের ক্ষেত্রে, ভারত ছিল ‘পাকিস্তানের মতো স্বৈরাচারী এবং বাংলাদেশ ও নেপালের চেয়েও খারাপ’। এভাবেই বিশ্বে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়, নিঃশব্দে নয়, রীতিমত হুঙ্কার দিয়ে। প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা সময়ের সাথে সাথে ক্ষুণ্ন হয়ে যায় । ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ এবং ‘দেশবিরোধী’ উপাদানগুলিকে আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে নিরপেক্ষ করা হয়। নির্বাচন হয়, কিন্তু বহির্বিশ্বের কাছে তা অবাধ বা সুষ্ঠু বলে গণ্য হয় না।
আরেকটি মজার দিক হলো যে, একবার এই ধরনের রাষ্ট্র গঠিত হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব না হলেও কঠিন। যেমনটা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে। তিক্ততা, বিদ্বেষ ছাড়া আজকে সেসব দেশে কোনো নির্বাচনই হয় না।
manabzamin