তারেক রহমানের ভবিষ্যৎ রাজনীতির ইঙ্গিত

আলফাজ আনাম
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৫১

আলফাজ আনাম

রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের মানুষের বড় প্রত্যাশা হচ্ছে রাজনীতিতে কিছুটা হলেও যেন গুণগত পরিবর্তন আসে। নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের মাঠের রাজনীতি ধীরে ধীরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। হাসিনার পতন ও পলায়নের পর দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি এখন জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। দেড় দশক পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, যা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতগুলো ইস্যুর দিকে মানুষ বিশেষ দৃষ্টি রাখবে। যার মধ্যে রয়েছে গণঅভ্যুত্থানের আগে ও পরে অপরাধের বিচার, ভারত প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এবং বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতির বদলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা।

তারেক রহমান বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কোন পরিস্থিতিতে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল এবং এক-এগারোর সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার কথা জানিয়েছেন, যা বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তারেক রহমান সে সময়ের ঘটনার হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘আমি ১৭ বছর প্রবাস জীবনে আছি। ওয়ান-ইলেভেন, তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় যেই শারীরিক নির্যাতন আমার ওপর হয়েছিল, তারপর চিকিৎসার জন্য আমি এই দেশে আসি। আমি যখন এই দেশে আসি, তখন আমি আমার ছোট ভাইকে রেখে এসেছিলাম। আমি যখন এই দেশে আসি, তখন আমার সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম। যেই ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি। যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল। যেই ঘরে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছিল। যেই ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল। সেই স্মৃতিগুলো ভেঙে-চুড়ে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম, সেই ভাই এখন আর নেই। যেই সুস্থ মাকে আমি রেখে এসেছিলাম, সেই সুস্থ মা এখন অসুস্থ। শুধু অসুস্থই নন, ওনার ওপর মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে।’

তারেক রহমান নিজের ও পরিবারের ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর চালানো একই ধরনের নিপীড়নের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন এবং তা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযোগ করেছেন। তিনি বলছেন, ‘আমি আমার পরিবারের যেই কাহিনি আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এটিকে আপনারা কাহিনি বলুন বা সংগ্রাম বলুনÑযেটাই বলুন না কেন, এটি শুধু আমার কাহিনি না বা আমার পরিবারের কাহিনি না। এ ধরনের কাহিনি বাংলাদেশের শত না, হাজার হাজার পরিবারের। যে পরিবারের বাবা, যে পরিবারের ভাই, যে পরিবারের স্বামী, তার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় মারা গেছেন, তা না হলে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় জেলের ভেতরে মারা গেছেন, সহায়-সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছেÑএসব অন্যায়, এসব হত্যা, এসব নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী, যারা এসবের হুকুম দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিচার হতে হবে। এটি প্রতিশোধের কোনো বিষয় নয়। এটি ন্যায়ের কথা। এটি আইনের কথা। যে অন্যায় করে তার বিচার হতে হয়। কার সম্পর্কে কী মনোভাব, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।’

তারেক রহমান খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘দল হিসেবে তারা (আওয়ামী লীগ) যদি অন্যায় করে থাকে, তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। দেশের আইন সিদ্ধান্ত নেবে। সোজা কথায়, অন্যায়কারীর বিচার হতে হবে। তো সেটি ব্যক্তি হোক বা সেটি দল হোক। যারা জুলুম করেছে, তাদের তো বিচার হতেই হবে। সেটি ব্যক্তিও হতে পারে। সেটি দলও হতে পারে।’

তারেক রহমানের এই অবস্থান স্পষ্ট করা খুব জরুরি ছিল। কারণ এ দেশের ভারতপন্থিরা এখন নানাভাবে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের বয়ান হাজির করছেন। এমনকি বিএনপির ভেতরে থাকা গুপ্ত বামরা সামাজিক মাধ্যম ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এ ধরনের মতপ্রকাশ করে থাকেন। তারেক রহমান এই সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

তারেক রহমানের বক্তব্যে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে—তা নিয়ে একটি সম্ভাব্য দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী পরস্পরের প্রতিযোগী। এই সাক্ষাৎকারে বিবিসি জামায়াত প্রসঙ্গ একাধিকবার আনার চেষ্টা করেছে। তারেক রহমান জামায়াতের নাম উল্লেখ না করে অত্যন্ত পরিমিত জবাব দিয়েছেন।

জামায়াতের রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বীকৃত যে নিয়ম, আইনকানুন আছে, এগুলোর ভেতর থেকে যদি কেউ রাজনীতি করে অবশ্যই করতে পারে। বিএনপি সবসময় বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কাজেই বিষয়টি আমরা এভাবেই দেখতে চাই। দেশের যে আইনকানুন আছে, তার ভেতর থেকে যারা রাজনীতি করবে, অবশ্যই সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে এবং আমরা তো চাই সবাই রাজনীতি করুক। বহুদলীয় রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি।’

জামায়াতের জোট গঠনের উদ্যোগকেও তিনি নেতিবাচকভাবে দেখেননি। তিনি বলেছেন, ‘ইলেকশন হলে তো প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতেই পারে। এতে উদ্বেগের কী আছে? বিএনপি তো আগেও নির্বাচন করেছে। বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচন করেছে। কম্পিটিশন করেই বিএনপি নির্বাচন করেছে। প্রতিযোগিতা করেছে। উদ্বেগের কিছু নেই।’

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের বিজয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপির সমর্থকরা যেভাবে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছিলেন, তারেক রহমান সেখানে ব্যতিক্রমী অবস্থান প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি ভালো উদ্যোগ এটি। ভালো সূচনা। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, যারা জয়ী হয়েছেন বা এ রকম আরো ভবিষ্যতে যারা জয়ী হবেন, তাদের প্রতি অগ্রিম শুভেচ্ছা। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছেÑদেখুন একটা অগ্রযাত্রা শুরু হলো, কিন্তু আমরা চাইনি যে কোনো নির্বাচন বিতর্কের মধ্যে পড়ুক। আমরা আশা করব পরে যে নির্বাচনগুলো হবে, সেগুলো বিতর্কবিহীন হবে।’

তারেক রহমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি ভারত প্রশ্নে তার ও দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছেন, ‘তিনি বলেছেন বিএনপির মূলনীতি একটাই সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে, এটি স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু। অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটি মেনে নেব না।’

হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত যে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সে বিষয়টিও সামনে এনেছেন তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, ‘এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটি বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের সঙ্গে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে। ভবিষ্যতে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে বাংলাদেশের স্বার্থ ও এ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে, তেমনটি জানিয়ে দিলেন তারেক রহমান।’

বিবিসি ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ভবিষ্যৎ বিএনপির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করা যায়। এ দেশের মানুষ এখন দলটির কর্মকাণ্ডে তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে চাইবে।

গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রচর্চা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল। এর অন্যতম প্রধান কৌশল ছিল জাতিকে বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই বিভাজনের সুযোগ নিয়েই গুম, খুন, দমন-পীড়ন এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিচারিক প্রক্রিয়ার নামে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে, যা ক্ষমতা রক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দেশের মানুষ কখনো চাইবে না এ ধরনের নিপীড়নমূলক শাসন আবার ফিরে আসুক। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপর এ দেশের মানুষ তীক্ষ্ণ নজর রাখছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here