সাইমুম পারভেজ
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা সরকারের পতন শুধু একটি শাসনক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজের কাঠামো পরিবর্তনে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার একটি স্পষ্ট প্রতিফলন। এই গণ-অভ্যুত্থান, বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ বাংলাদেশে একটি নতুন ‘পাবলিক স্ফেয়ার’ বা জনপরিসর তৈরি করে করেছে।
সুশীল সমাজের বিন্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে অবদান রাখা, রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনব্যবস্থায় শরিক হওয়ার যে প্রবণতা, তা নতুন সময় ও বন্দোবস্তের ইঙ্গিত দেয়। এই নতুন সময়ের বুদ্ধিজীবিতা কেমন হবে এবং জনপরিসরে গণমানুষের পরিচয় তৈরিতে সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকেরা কী ভূমিকা রাখবেন, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
এ কথা এখন স্পষ্ট যে বাংলাদেশে বর্তমান আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি জনভিত্তি ও প্রাসঙ্গিকতা—দুটিই হারিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহযোগিতায় কাঠামোগত (সিস্টেমেটিক) হত্যাকাণ্ড হয়েছে, গুরুতর আহত হয়েছেন হাজারো মানুষ। এই হত্যাযজ্ঞ আওয়ামী লীগের রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখা এই দলকে এখন তার নিজের দেশের মানুষের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে হবে। হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের বিচারের মুখোমুখি করা এখন জনদাবি।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজের পরিচয় নির্মাণপ্রক্রিয়ার একটি বড় অংশই প্রধানত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানবিরোধিতা ও শেখ মুজিবের বিশালতার যে মহাবয়ান (গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ), তার ওপর ভিত্তি করেই রচিত। আওয়ামী লীগের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই একক বয়ানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বকে সমুন্নত রাখা, বাংলাদেশ গঠনে শেখ মুজিবের সঙ্গে সঙ্গে অন্য নেতাদেরও মূল্যায়ন করা এবং বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে চ্যালেঞ্জ, তা বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্র পরিচালকদের বোঝা জরুরি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সিভিক ন্যাশনালিজম’ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বাংলায় একে আমরা ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’ বলতে পারি। একই সংস্কৃতি, ভাষা বা ধর্মের ওপর ভিত্তি করে যে জাতীয়তাবাদ তা ‘এথনোসেন্ট্রিজম’ বা ‘জাতিকেন্দ্রিকতা’ দুষ্ট। অধ্যাপক ডোনাল্ড ইপারসিয়েলের মতে, এথনিক জাতীয়তাবাদ কর্তৃত্ববাদী, এমনকি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা তৈরির অনুকূল অবস্থা তৈরি করে (দেখুন কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সিভিক ন্যাশনালিজম, ২০০৭)।
এর বিপরীতে রাষ্ট্রের সীমানা নির্ভর নাগরিকত্বভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদ, তাতে কাঠামোগতভাবেই বহুত্ববাদকে অনুপ্রাণিত করে। কারণ, সিভিক ন্যাশনালিজম বা নাগরিক জাতীয়তাবাদে এ একই ভাষা বা সংস্কৃতি নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, উদার নীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস আনাই জাতীয়তার শর্ত।
বিএনপির মনে রাখা উচিত, হাজারো মানুষের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। এই ত্যাগের পেছনে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার রক্তের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিরও দীর্ঘ সংগ্রাম, জেল-জুলুমের অবদান রয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, লাখো মামলার শিকার হয়েছেন। নিশ্চয়ই আরেকটি কর্তৃত্ববাদী ও গণতন্ত্রহীন শাসনব্যবস্থার জন্য এই ত্যাগ কেউ করেনি।
আর্নেস্ট রেনান (১৮৮২), হ্যান্স কোন (১৯৪৪) ও ক্লিফোর্ড গির্টজ (১৯৬৩)-এর গবেষণায়ও পশ্চিমের কার্যকর গণতন্ত্রের বিকাশের পেছনে নাগরিক জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’-এর আদলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাফল্য ইতিহাসে স্বীকৃত। রাষ্ট্রীয় আইনগত, নীতিগত ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক জাতীয়তাবাদে যে কেউ সহজেই একীভূত (ইন্টিগ্রেট) হতে পারে। এর বিপরীতে একই ভাষা, সংস্কৃতি, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তৈরি জাতীয়তাবাদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসহনশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাংলাদেশের মূলনীতি যদি সাম্য, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা ও সহনশীলতার ওপর নির্মিত হয়, তবে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিভেদ থেকে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে দায় বিএনপির। নাগরিক জাতীয়তাবাদের ধারণা এই দলের কাছে নতুন নয়। কারণ, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন, তা আসলে তাত্ত্বিকভাবে ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’-এর সবচেয়ে কাছাকাছি। তবে জাতীয়তাবাদের এই ধারাও যেন কর্তৃত্ববাদে পরিণত না হয়, সে লক্ষ্যে নাগরিক সমাজ ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব কমানো প্রয়োজন।
বিএনপি গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে বিএনপিকে নিয়ে একধরনের দ্বিধা লক্ষ করা যায়। বিএনপির সঙ্গে সহযোগিতা করার এই দ্বিধা দল হিসেবে বিএনপি এবং দলটির নেতা তারেক রহমান উভয়ের প্রতিই। কিন্তু ন্যায়ভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দুই পক্ষ থেকেই এই দ্বিধা কাটিয়ে তোলা জরুরি।
নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তারেক রহমানের অবদান রয়েছে। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থান ও ৫ আগস্ট-পরবর্তী অস্থির সময়ে তারেক রহমান বেশ কিছু সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য ও বিবৃতিতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। বিশেষ করে বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার বিষয়টি বারবার তাঁর বক্তব্যে এসেছে। বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে প্রচারিত একটি বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বাঙালি-অবাঙালি, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী কিংবা সংস্কারবাদী প্রত্যেক নাগরিকের একমাত্র পরিচয়—আমরা বাংলাদেশি।’
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বেশ কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগের সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়। এর পেছনে বেশির ভাগ কারণই ছিল রাজনৈতিক। এ ছাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ চাঁদাবাজি ও দখলদারিতে লিপ্ত হন। এই দুটি ক্ষেত্রেই তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি বেশ দ্রুততার সঙ্গে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন।
এ ছাড়া শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে কারণ দর্শানো নোটিশ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন নিজ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। জুলাই অভ্যুত্থানে তাঁর আহত-নিহত ব্যক্তিদের সাহায্য-সহযোগিতা করার খবর প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি কার্টুনিস্টের প্রশংসা করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরেন। হাসিনার শাসনে এই ‘অপরাধে’ কার্টুনিস্টদের জেল দেওয়া হয়েছে, কারাগারে মৃত্যুও হয়েছে। তাই দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্য চোখে পড়ার মতো।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ তারেক রহমান ও বিএনপির বিরুদ্ধে ‘জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতা ও দুর্নীতি’র অভিযোগ তোলেন। কিন্তু বিচার বিভাগের অসীম দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর পরও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণিত হয়নি। বরং তাঁর বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আওয়ামী লীগের নেতায় পরিণত হওয়া এবং সংসদ সদস্যের মনোনয়ন পাওয়া, তাঁকে খালাস দেওয়া বিচারকের হয়রানি—মামলাগুলোর অসারতা তুলে ধরে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদেরও হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, টাকা পাচার, ব্যাংক লুট, মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতির সামনে বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্বল দুর্নীতির অভিযোগ ঠুনকো মনে হয়।
২০১৬ সাল থেকেই বিএনপি রাষ্ট্রকাঠামোতে সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে আসছে। দলটির ৩১ দফায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির যে নীতিগত দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা দলটির জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে ফেরারই স্পষ্ট ইঙ্গিত। জিয়ার সিভিক ন্যাশনালিজমের যে ধারা, তাতে বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িকতা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড বিএনপির ঘরে ফেরারই লক্ষণ।
বিএনপির মনে রাখা উচিত, হাজারো মানুষের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ কর্তৃত্ববাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। এই ত্যাগের পেছনে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার রক্তের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিরও দীর্ঘ সংগ্রাম, জেল-জুলুমের অবদান রয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, লাখো মামলার শিকার হয়েছেন। নিশ্চয়ই আরেকটি কর্তৃত্ববাদী ও গণতন্ত্রহীন শাসনব্যবস্থার জন্য এই ত্যাগ কেউ করেনি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের তারেক রহমান ও বিএনপির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ক্রমেই দৃশ্যমান। বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা, সাম্য, ন্যায়বিচার ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে মধ্যপন্থী দলগুলোর উত্থান ও টিকে থাকা জরুরি। গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত শক্ত জনসমর্থন ও নেটওয়ার্ক বিএনপির রয়েছে। সে জন্য সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে সুস্থ রাজনীতি ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে নাগরিক সমাজ ও বিএনপির একে অপরের সঙ্গে একযোগে কাজ করা উচিত।
● ড. সাইমুম পারভেজ জার্মানির ডয়চে ভেলে একাডেমি ও বন রাইন-জিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক শিক্ষক
prothom alo