তাদের ‘দায়মুক্তি’ দেয়াই উচিত


মনে হয়, বাংলাদেশে এখন দায়হীনতার সংস্কৃতি চলছে। যেকোনো কাজে সাফল্যের কৃতিত্ব নেয়ার জন্য সবাই একপায়ে খাড়া শুধু নয়, মনে হয় শূন্যে ভাসছেন। কিন্তু ব্যর্থতার দায়টুকু কেউ নিতে চান না। এমনকি দায় আসলে কার সেই দায়িত্বশীলকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকারের কোনো দফতরেই এখন আর জবাবদিহির তেমন কোনো বালাই নেই। শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে একই প্রবণতায় সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার অধীনস্তদের কোনো কাজের হিসাব নেয়ার দরকার মনে করেন না কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি, সাহসও পান না। কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন আছে। কর্মকর্তা যদি অধীনস্থের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে যান, সে গিয়ে ইউনিয়নের শরণাপন্ন হয়। আর ইউনিয়ন জানে কোন অফিসারের কোথায় কী দুর্বলতা। তারা হইচই না করে ভদ্রভাবেই রিকোয়েস্ট করে, ‘স্যার, অমুকের ব্যাপারটা চেপে যান’। চেপে না গেলে কী হতে পারে তার একটু আভাস-ইঙ্গিত হয়তো কোনোভাবে তার কানে পৌঁছানো হয়। ব্যস। আর কিছুই করার দরকার হয় না। অপরাধী বা ব্যর্থ কর্মচারী রেহাই পেয়ে যায় অনায়াসে।

যখন রিপোর্টিং করতাম তখন এমন সরকারি প্রতিষ্ঠানও দেখেছি যেখানে শীর্ষ কর্মকর্তাও ট্রেড ইউনিয়নের ভয়ে অপরাধীদের নাম নেয়ার সাহস পান না। উল্টো ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা সাংবাদিকদের ‘ম্যানেজ’ করে নেন যাতে ওই প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোনো নেতিবাচক খবর পত্রিকায় প্রকাশ না পায়।

এই পরিস্থিতি কেন? কারণ হাতেগোনা দু’চারজন ছাড়া দেশের সব কর্মজীবীই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছেন। একেবারে নিচে থেকে উপরের স্তর পর্যন্ত ঘুষ ভাগাভাগি করা হয়- এমন প্রতিষ্ঠান তো ভ‚রি ভ‚রি। ফলে ঘুষখোর অফিসারের পক্ষে একই কাজে লিপ্ত অধঃস্তনকে শাসন বা জবাবদিহি করতে বাধ্য করা কিভাবে সম্ভব? যে কর্মকর্তা অফিসের কেনাকাটায় বিপুল অঙ্কের ভুয়া বিল অনুমোদন করেন তিনি মোটা ভাগ পান বলেই সেটা করেন। তাহলে ৫০০ টাকার একটি বালিশের দাম সাত হাজার টাকা হলে উনি ঠেকাবেন কেন? সুতরাং দেশ চলছে ভাগেযোগে। যে যেটুকু কাজ করে, সেটুকুই জাতির সৌভাগ্য। সৌভাগ্য যে, চার হাজার টাকা দামের বই ‘মাত্র’ ৮৫ হাজারে কেনেন সরকারি কর্তারা, লাখ টাকার জানালার পর্দা কেনেন মাত্র ৩৭ লাখে, একটি টেলিফোন ‘মাত্র’ই ১৫ লাখ টাকায় কিনতে পারেন তারা, হাসপাতালের হেডকার্ডিয়াক স্টেথোস্কোপ সংগ্রহ করতে পারেন এক লাখ ১২ হাজার টাকার মধ্যে, একটি এসি বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কেনেন ৫২ লাখ টাকায়। ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মেশিন কিনে ফেলেন ‘মোটে’ই ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। একটি ল্যাপটপ কেনেন তিন লাখ টাকায়। এসব তো অহরহ হচ্ছে এ দেশে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, যে টেবিলটি তারা ১২ লাখ টাকায় কিনলেন, যে চেয়ারটির দাম ৫০ হাজার টাকা দেখালেন, সে দু’টি জিনিসের দাম যদি যথাক্রমে ২০ লাখ এবং দুই লাখ টাকা দেখাতেন তাহলেই বা কে কী করতে পারতেন? একটু চিন্তা করলেই বুঝবেন, এর পেছনে কাজ করেছে তাদের সামান্য চক্ষুলজ্জা। এটুকু না থাকলেও আমাদের কারো কিছু করার সাধ্য ছিল না। জাতিকে তবু তো তারা ‘খেদমত’ করে যাচ্ছেন ‘অক্লান্ত’ভাবে। কোনো কেনাকাটা না করে তো বিল তোলেননি।

সুতরাং আমাদের, মানে সাধারণ জনগণের কি উচিত নয় জাতীয় উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত এসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সব রকম জবাবদিহির ঊর্ধ্বে রেখে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা? আর সব নিয়ম-কানুন, প্রতিষ্ঠিত কর্মপ্রক্রিয়া বর্জন করে যারা জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে বিরাট অঙ্কের সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প নিচ্ছেন তাদেরই বা নিন্দামন্দ করি কী করে? দেশে সরকারি উন্নয়ন কাজ বিতরণে টেন্ডার ভাগাভাগি এখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। ‘সর্বনিম্ন দরে কাজ দেয়ার সেই পুরনো রীতি’র অবসান ঘটিয়ে একটি ‘সমঝোতামূলক’ নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে যেখানে কোনো মারামারি, কাটাকাটি, বোমাবাজি, অফিস দখলের হাঙ্গামা বা ঝামেলা নেই। জনগণকে নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হতে হচ্ছে না। একটি-দু’টি কাজ হয়তো ১০০ ভাগের জায়গায় ৪০ ভাগ হচ্ছে কিংবা নির্ধারিত মানের রড-সিমেন্টের বদলে বাঁশ ও বালু দিয়ে সড়ক বা ভবনের ছাদ ঢালাই করা হচ্ছে। কিন্তু কিছু না কিছু হচ্ছে তো। ‘উন্নয়ন’ থেমে নেই। ‘ঈদের পরেই তীব্র আন্দোলনের’ সমর্থক যেসব ঠিকাদার তাদের বাদ পড়া তো ‘খুব জরুরি’। এরাই একসময় ওই আন্দোলনে অর্থ-শক্তি-জনবল দিয়ে শরিক হবেন না তার গ্যারান্টি কী? তাতে করে ‘সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী’র এগিয়ে যাওয়ার পথ খোলাসা হওয়ার শঙ্কা কেউ উড়িয়ে দিতে পারছেন না। তার চেয়ে বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি উত্তম নয় কি?

একই অবস্থা সম্ভাব্যতা যাচাই না করে বা সমীক্ষা না করেই সরকারি প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেও। সম্প্রতি অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে যথাযথ সমীক্ষা ছাড়াই। জাতীয় অর্থনৈতিক কমিশন সেগুলো অনুমোদনও করেছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে একটি উদাহরণ দেই। ঘটনাটি ঘটেছে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ও গাইবান্ধার বালাসী নৌপথে ফেরি চলাচল সম্পর্কিত একটি প্রকল্পে। ফেরির জন্য ঘাট বানানো হয়েছে। অতিশয় সুদৃশ্য অবকাঠামো বানানো হয়েছে। ঝকঝকে সড়ক, টার্মিনাল ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। এমনকি নান্দনিক ছোঁয়া দেয়ার জন্য যথারীতি কেয়ারি করে সুদৃশ্য ফুলের বাগানেও ভরিয়ে তোলা হয়েছে রঙিন ফুল দিয়ে। খনন করা হয়েছে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌপথ। এসব করতে সরকারের (পড়ুন, জনগণের) অর্থ ব্যয় হয়েছে ‘মাত্র’ ১৩৬ কোটি টাকা। হ্যাঁ, মাত্রই তো! কারণ ব্যাংকে দেখুন, যত বড় অঙ্কের চেকই কাটুন না কেন, টাকার অঙ্কের আগে ‘মাত্র’ কথাটিই তো অনিবার্যভাবে লেখা থাকে। এটা নাকি নিয়ম।

তো সেই ১৩৬ কোটি টাকা (মাত্র) ব্যয় করার পর এখন জানা গেল, এই রুটে ফেরি চালানো সম্ভব নয়। বস্তুত কয়েক দফায় ফেরি চালানোর ট্রায়াল ফেল করেছে ইতোমধ্যে। গত জুনে ফেরি চলাচল শুরু করার কথা ছিল। এখন এর পুরো প্রকল্পই বাতিল হওয়ার পথে।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা ছাড়াই কোনো একটি কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টের ভিত্তিতে ওই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সমীক্ষা ছাড়া শত কোটি টাকার একটি প্রকল্প ‘একনেক’ কিভাবে অনুমোদন করল সেটি ভেবে মাথায় ঘাম ছোটানোর আগে ভাবুন; এই ঘাম আপনারই পায়ে পড়বে। অন্য কেউ আপনাকে ঘামতে দেখে ঘর্মাক্ত হবে না। এসব দেখার দায়িত্বে যারা আছেন তারা তো নয়ই। অতএব, প্রয়োজনে পানি ঢেলে হলেও মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। তাতে স্ট্রোকের শঙ্কা কমবে।

মজার ব্যাপার হলো, ওই প্রকল্পে যে অবহেলা এবং দায়িত্বহীনতার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে তার দায় কার সেটি বের করার কোনো উদ্যোগ কেউ নেননি। না মন্ত্রণালয়, না আর কেউ। এমনকি কেউ দায় স্বীকারও করেনি। মূল দায় কার সেটি খুঁজে বের করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সাংবাদিক।

একই অবস্থা পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রে। সেখানে পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় পিডিবির গচ্চা যাচ্ছে প্রতি মাসে শত কোটি টাকা বা তারও বেশি। ঘটনাটি এমন- বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। উৎপাদন হচ্ছে ৫৪০ মেগাওয়াট, যা সক্ষমতার মাত্র ৪১ শতাংশ। এখানে একটি সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ সময়মতো শেষ না হওয়ায় পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সে কাজ সম্পন্ন হতে আরো এক বছর লাগতে পারে। এই এক বছর ধরে বিদ্যুৎ না কিনলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) ক্ষতি গুনতে হবে । এতে করে কত হাজার কোটি টাকা পানিতে পড়বে, কেউ জানে না। তবে সান্ত্বনা এই যে, হাজার কোটি টাকাও তো ‘মাত্র’ই। আমাদের একজন সাবেক অর্থমন্ত্রী অর্থ নিয়ে অনর্থ বাধানোর ‘রাবিশ’ অনুশীলনে না গিয়ে চার হাজার কোটি টাকাকে বলেছিলেন ‘সামান্য’ টাকা। আমরা জেনে খুশি হয়েছিলাম যে, হাজার হাজার কোটি টাকাও এখন আমাদের কাছে ‘সামান্য’ অর্থ মাত্র। কে না জানে অর্থই সব অনর্থের মূল! সুতরাং এসব নিয়ে মাথা যত কম ঘামাবেন তত নিজের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।

শুধু জেনে রাখুন, পায়রা কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় সঞ্চালন লাইনে (গ্রিড লাইনে) নেয়ার জন্য একটি নয়, তিন তিনটি প্রকল্প নেয়া হয়। তিনটি প্রকল্পের ব্যয় মোট ব্যয় ছয় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু একটি প্রকল্প হলে ব্যয় কমত। এমন ধারণা জানাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাই। যাই হোক, তিনটির মধ্যে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্য দু’টি চলমান। সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি)। লাইন নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়ার জন্য এই পিজিসিবিকে দায়ী করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আর পিজিসিবি বলেছে, করোনা মহামারী এবং নদীর উপর দিয়ে লাইন নির্মাণে জটিলতার জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগছে। আমাদের কোনো প্রযুক্তিগত বা কারিগরি জ্ঞান নেই। তবে এটুকু সাধারণ বুদ্ধি নিশ্চয়ই আছে যে, প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণের সময় প্রকল্পের কর্মপরিধি ও সম্ভাব্য জটিলতাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তা করা হয়। তাই পিজিসিবির বক্তব্যে যুক্তির চেয়ে দায় এড়ানোর প্রবণতাই মুখ্য বলে মনে হয়। তবে এই দায় একা পিজিসিবির মনে করার কারণ নেই। এই ব্যর্থতার দায় বিদ্যুৎ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানেরই। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সাথে সাথে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শুরু করলে এখন কেন্দ্রটিকে এভাবে অলস বসে থাকতে হতো না।

নির্মাণ পরিকল্পনায় সমন্বয়হীনতা, অর্থের অপচয় এগুলো সবসময়ই ছিল। এখনো আছে, এতে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। উন্নয়নের যে ‘জোয়ার’ আমরা সৃষ্টি করেছি তাতে কিছু ভাঙচুর, কিছু আবর্জনা, কিছু হাতের ময়লা ধুয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কি?

mujta42@gmail.com