আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে হঠাৎই ‘রাজনৈতিক সমঝোতার’ বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আনল কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে একাধিক দল আছে, যারা সরকারঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তফসিল ঘোষণা এই হচ্ছে, এই হবে—এমন প্রেক্ষাপটে সমঝোতার কথাটি কেন সামনে এল, তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে রাজনৈতিক মহলে।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন এক ধাপ এগিয়ে। দলটি ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ ছাড়া তফসিল ঘোষণা করলে সেদিন ঢাকায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিলের কর্মসূচিও দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তফসিল ঘোষণার আগে হঠাৎ ‘রাজনৈতিক সমঝোতার’ জন্য ইসলামি এই দলগুলোর এমন অবস্থানের পেছনে সরকারি মহলের সায় আছে। তারা চাইছে, এ ধরনের একটি উদ্যোগ থাকুক। সংলাপে কার্যকর কিছু না হলেও এর লক্ষ্য, সরকার যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে সচেষ্ট, সেটি আন্তর্জাতিক মহলকে দেখানো। একই সঙ্গে বিএনপিকে আরও চাপে ফেলাও এর লক্ষ্য।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভেতর থেকে জানা যায়, সংলাপ বা রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে পশ্চিমা প্রভাবশালী একাধিক দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে সরকারের দিক থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ হয়েছে, এমনটা জেনেছে ওই দলগুলো। যাতে নির্বাচন সামনে রেখে তারা একটা উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নেবেন বলে সরকারের একটি মহল থেকে তাদের কাউকে কাউকে প্রায় দুই সপ্তাহ আগেই আভাস দেওয়া হয়।
গত সপ্তাহেই এক যৌথ বিবৃতি দিয়ে পাঁচদলীয় রাজনৈতিক মোর্চা ‘সমমনা ইসলামি দলগুলো’ নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) তফসিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানায়। তারা বলেছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচনের দাবি উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হতে পারে। এই জোটের শরিকেরা হলো—বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, মুসলিম লীগ (বদরুদ্দোজা আহমেদ-কাজী আবুল খায়ের) ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। এর মধ্যে চারটি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস এক সময় বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। বিভিন্ন সময়ে তারা জোট থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান নেয়।
এর মধ্যে মুসলিম লীগ ছাড়া অন্য দলগুলোর সঙ্গে সরকারের একধরনের যোগাযোগ বা সম্পর্কের কথা বিভিন্ন সময়ে জানা যায়। এখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রাক্কালে রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর জোরালো অবস্থান, তারই অংশ কি না—তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
সমঝোতার আহ্বানের পেছনে কী
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের গতকাল সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাউকে কাউকে নিয়ে একটু সংশয়-সন্দেহ ছিল, এটা ঠিক। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা ‘সমমনা ইসলামি দলগুলো’ একমত হতে পেরেছি, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কথা পরিষ্কার, নির্দলীয় সরকারের দাবি উপেক্ষা করে তফসিল ঘোষণা করলে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।’
এর মধ্যে গতকালই দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
এদিকে সরকারি দলের দিক থেকে জানা যায়, পশ্চিমা আরেকটি প্রভাবশালী বড় দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। সরকার চাচ্ছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিতর্ক এড়াতে একটা সমঝোতার উদ্যোগ হোক। তবে এই উদ্যোগ সরকার নিজে নিতে চায় না, সেটি আন্তর্জাতিক মহল থেকে হোক। যদিও কোনো বিদেশি কূটনীতিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার উদ্যোগ নেবেন কি না, তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শর্তহীন সংলাপের বিষয়ে জোরালো অবস্থানে সরকার ও বিরোধী দল—দুই পক্ষই অস্বস্তি আছে।
ইতিমধ্যেই বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। সমঝোতার ক্ষেত্রে তিনি জাতিসংঘের মধ্যস্থতার কথা বলেন। মেজর হাফিজের নেতৃত্বে নতুন দল হচ্ছে বলেও দলীয় এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনার সৃষ্টি হয়। যদিও পরে সংবাদ সম্মেলনে মেজর হাফিজ জানিয়েছেন, তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক নয়, তিনি এখনো বিএনপিতেই আছেন।
একদিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি, অন্যদিকে রাজনৈতিক সমঝোতার আহ্বান—এমতাবস্থায় পর্দার অন্তরালে কিছু হচ্ছে কি না এবং পরিস্থিতি কোন দিকে যায়—সবাই তা বুঝতে চায়। যার কারণে ভোটে যাওয়ার জন্য চাপ থাকলেও ছোট ছোট দলগুলো সময় নিচ্ছে। তারা শেষ মুহূর্তে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে চায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলের একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে জানান, সপ্তাহ দুই আগে তাঁদের কাছে প্রস্তাব আসে সংবাদ সম্মেলন করে ৩০০ আসনে নির্বাচন করার ঘোষণা দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তা এখনো তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। এ কারণে তাঁরা চাপ থাকা সত্ত্বেও সংবাদ সম্মেলন করেননি।
কথা বলে জানা যায়, বিএনপির সঙ্গে সরকার হটানোর এক দফার আন্দোলনে থাকা জামায়াতে ইসলামীর ওপরও চাপ আছে ভোটে যাওয়ার। এর মধ্যে আলোচনায় রয়েছে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা সংক্রান্ত মামলাটি। গত রোববার এ মামলার শুনানির কথা ছিল। শুনানির দিন পিছিয়ে ১৯ নভেম্বর ধার্য করা হয়েছে। এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আনা আবেদনের শুনানিও একই দিন হওয়ার কথা রয়েছে। এই সময় পেছানো নির্বাচনী সমঝোতার অংশ কি না, সে নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দিন শেষে সরকার বিএনপিকে বাইরে রেখেই নির্বাচন করতে চায়। সে লক্ষ্য ধরেই সরকার নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়াতে ছোট-বড় বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তবে দলগুলো রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি দেখে শেষ মুহূর্তে ভোটে যাওয়া, না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চায়।
প্রথম আলো