- এম এ করিম
- ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:১৯
সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে স্বৈরশাসন ও কর্তৃত্ববাদী সরকার কোনো অবস্থান নিতে পারেন না। সংসদীয় সরকারের শাসনামলে দেশে বিরাজমান থাকবে গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের মহিমা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল উৎস ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগের অধিককাল ক্ষমতাসীন সরকার দেশ থেকে গণতন্ত্রকে একরকম বিতাড়িত করে খেয়ালখুশিমত দেশ শাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ক্ষমতাসীনরা দেশ থেকে স্বাধীনতার মূল স্তম্ভ গণতন্ত্র নস্যাৎ করে জোরগলায় বলে যাচ্ছে, দেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান, তাদের শাসনামলেই দেশে গণতন্ত্র নিরাপদ থাকে। এভাবে তারা দেশ-বিদেশে তাদের অবস্থান সম্পূর্ণভাবে আড়াল করার কৌশল নিয়েছে।
সংবিধান অনুযায়ী দেশে পাঁচ বছর পর পর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের বিধিব্যবস্থা রয়েছে। ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলে সংবিধান সংবিধান বলে চিৎকার করে। এর মাধ্যমে তারা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি জনগণের, দেশের সব বিরোধী দলের, সেই দাবি উপেক্ষা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার পুরনো কৌশলে অবতীর্ণ।
ক্ষমতাসীন সরকারের শাসনামলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গণতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলাদেশের মূল স্তম্ভ গণতন্ত্রকে শুধু যে আইসিইউতে পাঠিয়েছে তাই নয়, গণতন্ত্রের দাফনও সম্পন্ন করে ফেলেছে। গণতন্ত্রের প্রধান হাতিয়ার জণগণের ভোটাধিকারে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দু’টি জাতীয় নির্বাচন একটি ‘ভোটারবিহীন’ অপরটি ‘নিশি রাতের ভোটারবিহীন নির্বাচন’। যা সংবিধানের মারাত্মক লঙ্ঘন। কিন্তু তার পরও সংবিধান বিরোধীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় থেকে মেকি উন্নয়নের জয়গান গেয়ে জনগণের সাথে তামাশা করে যাচ্ছে।
দেশের প্রধান শক্তিশালী জনপ্রিয় বিরোধী দল বিএনপি ও ২০ দলীয় ঐক্যজোটের ২০১৪ ও ২০১৫ সালে গণতন্ত্র উদ্ধারের ঐতিহাসিক আন্দোলনকে ক্ষমতাসীনরা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পেছনে ছুরিকাঘাত করে। আগুন সন্ত্রাসী দল হিসেবে মিথ্যা অপপ্রচারে ক্ষমতাসীন ও তাদের জোটের শরিকরা মাতোয়ারা। অথচ আগুন সন্ত্রাসের উল্লিখিত ঘটনা আদৌ প্রমাণিত বা উদঘাটিত নয়। সুষ্ঠু তদন্ত হলে অপরাধীর কাঠগড়ায় ক্ষমতাসীনদেরও দাঁড়াতে হতে পারে। দেশে চলমান ক্রসফায়ারে হত্যা, গুম, খুন, নির্যাতন, গণতন্ত্রের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী হামলা, বিরোধী দলের ৪০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা- ক্ষমতায় থাকারই মরিয়া অপকৌশল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মুক্তিযুদ্ধের চালিকাশক্তি সংসদীয় গণতন্ত্র ছিল কাগজে কলমে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার হাত ধরে দেশ আবারও সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে পায়। ৬ ডিসেম্বর নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকার পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনামলে ১৯৯১ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচন দেশ-বিদেশে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে প্রশংসা পায়।
তখনকার পর্যায়ে ১৯৯১ সালের শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনকে প্রধান বিরোধী দলনেত্রী শেখ হাসিনা সূক্ষè কারচুপি বলে নিজের দল ও নিজের ইমেজ রক্ষা করার জন্য রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। পরবর্তী জামায়াতে ইসলামের আমির গোলাম আজমের আবিষ্কৃত কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট অর্থাৎ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে আওয়ামী লীগের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির মুখ্য ভূমিকায় দখল করেন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিপরীত অবস্থানে থেকেও সর্বশেষে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি জোরালো হয়ে যায়, যার দরুন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত বিএনপি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়ে সংসদের মাধ্যমে বিরোধী আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ সম্মিলিতভাবে ঐকমত্যের ফর্মুলাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় নির্বাচনকালীন পর্যায়ে সংবিধানে স্থান পেয়ে যায়। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ধরেই পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অধিক আসন পেয়ে জয় পেয়ে ১৪ দলীয় জোটসহ সরকার গঠনের সুযোগ পেয়ে যায়। এমনকি ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে ও ১৪ দলীয় জোট জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়।
তত্ত্বাবধায়কের একই ফর্মুলায় ২০০১ সালে ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলাতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোই ছিল দেশের সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন।
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া শতভাগ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগ ও তাদের ১৪ দলীয় বাম জোট অনুধাবন করতে লাগল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাই তারা চারদলীয় জোটের শাসনামলে আন্দোলনে এক-এগারোর মঈন-ফখরুদ্দীনের অবৈধ সরকার আসার পথ সুগম করে দিয়েছিল, যার প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দীর্ঘ এক বছর বিভিন্ন মামলায় হাজতবাস এবং উভয় দলের অসংখ্য নেতা, সংসদ নেতা, জেল-জুলুম, মামলা-হামলার শিকার হন। যার দায়ভার ১৪ দলীয় জোটের ওপরেই বর্তায়।
পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তাদেরই আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিচার বিভাগের মাধ্যমে সংবিধান থেকে উধাও করে দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীনরা ভোটারবিহীন প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ শাসন করে দেশকে গণতন্ত্রবিহীন করে দেশের বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। দেশকে এক অরাজকতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে যত সব অরাজকতা বিভক্তি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তিই তার একমাত্র কারণ।
দ্বাদশ নির্বাচন আসতে বাকি আরো দেড় বছর। ইতোমধ্যে দেশে সীমাহীন দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কশাঘাতে জনগণ জর্জরিত, জ্বালানি তেল, ডিজেল, পেট্রল, অকটেন ইত্যাদির ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিতে, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে দেশের জনগণ সরকারবিরোধী প্রচণ্ড প্রতিবাদে মুখর। প্রধান বিরোধী দলসহ অপরাপর বিরোধী দল, সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনগণ ক্ষুব্ধ। দেশের এ নাজুক অবস্থায় রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ভোলা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের বুলেটে তিনজনের প্রাণ কেড়ে নিয়ে রাজপথকে রক্তে রঞ্জিত করেছে সরকার। তার দায়ভার সম্পূর্ণ সরকারের। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ড। গণতন্ত্রের আন্দোলনে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এই শহীদী রক্তভার ক্ষমতাসীন সরকার বহন করতে পারবে না।
ক্ষমতাসীনরা দেশে হারানো গণতন্ত্র উদ্ধারের আপসহীন নেত্রী, তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মাদার অব ডেমোক্রেসি খালেদা জিয়াকে সাজানো মামলায় সাজা দিয়ে বন্দী অবস্থায় রেখে দিয়েছে।
ক্ষমতাসীনদের কৌশল বিএনপির চেয়ারপারসন রাজবন্দী নন। একজন নিছক দুর্নীতির মামলার অপরাধী। কিন্তু তাতে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কারিশমা নস্যাৎ করতে পারেনি। মুক্ত খালেদা জিয়া রাজপথে নেমে এলে ক্ষমতাসীন সরকারের আয়ু নিঃশেষ হয়ে যাবে, ক্ষমতাসীনরা তা অনুধাবন করতে সক্ষম। সেজন্যেই তাকে বন্দিদশায় রেখে নিঃশেষ করে দিতে চাচ্ছে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য দেশের গণতন্ত্রমনা জনতার স্রোতে বন্ধ করার জন্যই ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিকভাবে তাকে মোকাবেলা না করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে ক্রসফায়ার, গুম, খুন, অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে উল্টো হাজার হাজার মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশে দুঃশাসনের নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সরকারের যত সব রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করার আয়োজন খালেদা জিয়ার ভূমিধস জনপ্রিয়তাকেই সামনে রেখে।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছুই নেই। অবস্থার প্রেক্ষাপটে গণভোটে ৯৮ শতাংশ নিশ্চিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। দেশের মানুষ জাগ্রত হয়েছে, দেশের সুশীল সমাজের সবাই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর, শক্তিশালী বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে অপরাপর বিরুদ্ধে দল ঐক্যবদ্ধ। শক্তিশালী বিরোধী শক্তি বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে দ্বাদশ নির্বাচন কোনো অবস্থায়ই সম্ভব নয়। ক্ষমতাসীনরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের কৌশলে আরেকটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হবে তা সম্পূর্ণ অবাস্তব। যেকোনো মূল্যে দেশে গণতন্ত্র ফিরে পেতে হবে এবং দ্বাদশ নির্বাচনেই তা হতে হবে। নির্বাচন কমিশনার বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল নতুন নতুন কায়দা কৌশলে ক্ষমতাসীনদের দ্বাদশ নির্বাচনে ক্ষমতায় আনতে তৎপর বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু তা সম্ভব হবে না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দাবিতে বাংলার রাজপথ প্রকম্পিত হবে। ফের ১৯৯৬ সালের প্রারম্ভিক রূপ ধারণ করবে। অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে ভবিষ্যতে পুনর্বার ক্ষমতায় আসার জন্য সংবিধানে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের মাধ্যমে সংযোজনে বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের রেখেই বিদ্যমান রাজনীতির সমাধান টানতে পারেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তিতে জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে স্থান পায় জনগণের ঐকান্তিক ইচ্ছার প্রতিফলনে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিরপেক্ষ-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে না পারলে দেশ গণতন্ত্র চিরতরেই হারিয়ে যাবে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।