- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৩ মে ২০২৩, ১৯:২৯
নির্বাচন ছাড়াই বর্তমান সংসদের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক অধ্যাপক যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন সোমবার বলেছেন, ‘বর্তমান সংসদ ও সরকারের মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়ানো প্রয়োজন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মানববন্ধনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন এমন এক সময়ে এ বক্তব্য দিয়েছেন, যখন বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ‘চাপ’ বাড়ছে। একই সাথে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মহলে অধ্যাপক জামাল উদ্দিন আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কেন এমন দাবি তুললেন শিক্ষক জামাল উদ্দিন?
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘একটা সংসদ বা সরকার গঠিত হয় পাঁচ বছরের জন্য। যেহেতু করোনা মহামারিতে আমাদের একটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কট হয়েছে, দু’বছর আমরা কাজ করতে পারিনি। অর্থনৈতিক সঙ্কট কিন্তু আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দু’বছর পার্লামেন্টে কোনো আলোচনা হয়নি। এমন বিবেচনায় আমি বলেছি যে যদি বিরোধী দলগুলোর সাথে ঐক্যমত্য হয়, এটাকে একটা দুর্যোগ পরিস্থিতি বিবেচনা করে যদি সংসদের মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া যায় কি-না। সেখানে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা কী হবে, তা আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’
নির্বাচনের সাথে মানুষের ভোটাধিকারের বিষয়টি জড়িত। নির্বাচন না হলে জনগণের ভোটের অধিকার কিভাবে রক্ষা হবে?
এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটের অধিকারের বিষয়টা তো আমরা অস্বীকার করছি না। অধিকার থাকবে। কিন্তু পার্লামেন্টের সদস্যরা সবাই তো জনগণের প্রতিনিধিত্বই তো করে। তাহলে তারা যদি চায়, তা তো জনগণের কথাই হবে।’
এ বক্তব্যের গুরুত্ব আছে?
অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের এ বক্তব্যের পরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে এ নিয়ে হাস্যরস করতে শুরু করেছে, আবার অনেকে এ বক্তব্যকে গুরুত্বের সাথেও নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক আলি রিয়াজ ফেসবুকে লেখেন, ‘এ বক্তব্যকে হেলাফেলা মনে করার কোনো কারণ নেই এবং তিনি কতটা পরিচিতি ব্যক্তি তাও বিবেচ্য বিষয় নয়।’
অধ্যাপক রিয়াজের মতে, দু’টি কারণে এ বক্তব্য আমাদের মনোযোগ দাবি করে। প্রথমত ঐতিহাসিক, দ্বিতীয়ত হচ্ছে এর উদ্দেশ্য।
তিনি লেখেন, ‘১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তৎকালীন সংসদের মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।’
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে রিয়াজ লিখেছেন, ‘রসিকতা করে হলেও অনেকেই লিখছেন এ প্রস্তাবটা খারাপ নয়, এতে করে অনেক টাকা বেঁচে যাবে, সেহেতু নির্বাচন করার আর দরকার নেই। তাদের অনেকেই যে এ মন্তব্য করছেন গত দুই নির্বাচনে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে তা বিবেচনা করে।’
তিনি আরো লেখেন, ‘এটি ক্ষোভের এক ধরণের বহিঃপ্রকাশও বটে। এ ধরনের কথাবার্তা নির্বাচনকে ছেলেখেলায় পরিণত করার চেষ্টাকেই সাহায্য করে। এগুলো হচ্ছে বিরাজনীতিকরণের অংশ।’
লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দন আহমেদ বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো এখন সরাসরি রাজনীতি করে, তার বক্তব্য পুরোপুরি রাজনৈতিক। এর মাধ্যমে তিনি তার আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত করেছেন। তিনি হয়ত ধরে নিয়েছেন, তারাই তো ক্ষমতায় থাকবে, তাহলে শুধু শুধু নির্বাচন করে লাভ কী?’
তবে তিনি বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য বা আলোচনা একেবারে নতুন নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, দেশের উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগকে আরো দুই দফা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, ‘এখন বিদেশীদের নড়াচড়ায় ক্ষমতাসীনরা অস্বস্তি বোধ করে। তাদের অনুগতরা জানে, এ সরকার না থাকলে তারাও বিপদে পড়ে যাবে। ফলে তাদেরও গোষ্ঠীগত স্বার্থ আছে। তিনি আসলে তার মনের কথাটা বেফাঁস বলে ফেলেছেন।’
কিন্তু শুধু তার এ বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রভাব তৈরি করবে না বলেই তিনি মনে করেন।
শিক্ষক সমিতি ও আওয়ামী লীগের বক্তব্য
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির অনুষ্ঠানে এ বক্তব্য দিয়েছেন, তাই তার এই বক্তব্যের সাথে শিক্ষক সমিতি একমত কি-না?
জানতে চাওয়া হলে সভাপতি মো: নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেছেন, ‘ড. জামাল উদ্দিন যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা তার ব্যক্তিগত মতামত। শিক্ষক সমিতি তার সাথে একমত নয়।’
শিক্ষক সমিতির নেতারা বলেছেন, এমন বক্তব্যের বিষয়ে সমিতির নেতাদের সাথে আগে কোনো আলোচনা করেননি ড. জামাল উদ্দিন।
আর আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়াম কমিটির সদস্য সাজাহান খান বলেছেন, এই বক্তব্যের সাথে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কথা বলার অধিকার কারো নেই, এটা আমরা মনেও করি না। আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করে না, করবেও না।’
ব্যাপক সমালোচনা হলেও অধ্যাপক জামাল উদ্দিন তার বক্তব্যে অনড় আছেন। তিনি নানা ‘যুক্তি ও ব্যাখ্যা’ তুলে ধরছেন।
তিনি মনে করেন, নির্বাচন আয়োজন করা হলে সরকার দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করবে। প্রার্থীরাও হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করবে। নির্বাচনে সহিংসতা হলে প্রাণহানি হবে, মামলা মোকদ্দমায় লোকজন জেলে থাকবে, সেটাও অর্থনীতির ক্ষতি।
তিনি আরো বলেন, ‘তাই আমি বলেছি যে নির্বাচন আয়োজনের বদলে সংসদের মাধ্যমেই সংসদ আর সরকারের মেয়াদ আরো অন্তত পাঁচ বছর বাড়িয়ে নেয়া ভালো।’
সূত্র : বিবিসি