ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হচ্ছে

  • তারেকুল ইসলাম
  •  ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:০০
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হচ্ছে – ফাইল ছবি

স¤প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামান চাঁনকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ভাইভায় উপস্থিত শিক্ষকদের সামনে নেকাব খুলতে অসম্মতি জানালে এক শিক্ষার্থীর ভাইভা নেয়া হয়নি এবং অন্য আরেক শিক্ষার্থীকে জোর করে নেকাব খুলে ভাইভা নেয়া হয়। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ওই ভাইভা বোর্ডের প্রধান ড. ওয়াহিদুজ্জামান ওই দুই নারী শিক্ষার্থীকে ‘উগ্রবাদী’ দলের সদস্য হিসেবে অপবাদ (ভিকটিম ব্লেমিং) দিয়ে বলেন, ‘যারা পর্দা করে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে বাসায় থেকে পড়াশোনা করা উচিত।’ এর প্রতিবাদে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে একদল ঢাবি শিক্ষার্থী বিক্ষোভ সমাবেশ করে এবং ড. ওয়াহিদুজ্জামানের বিচার চেয়ে ভিসি বরাবর স্মারকলিপি দেয়।

পরীক্ষা ও ভাইভায় শিক্ষার্থীদের পরিচয় শনাক্তকরণের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই জরুরি বিষয়। পর্দাশীল নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নারী শিক্ষিকা বা নারী কর্মচারীদের দিয়ে চেক করার মাধ্যমে বিষয়টির সহজ সমাধান সম্ভব। তা ছাড়া এই ডিজিটাল যুগে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় তা আরো সহজ। কিন্তু এমন সহজ উপায় থাকা সত্ত্বেও পরিচয় শনাক্তকরণের অজুহাতে পর্দার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং পর্দাবিরোধী কথাবার্তা বলা ইসলামবিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু নয়। এতে করে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুভূতিতেও আঘাত লাগে।

ওয়াহিদুজ্জামানের বক্তব্য অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক। কারণ তিনি অন্যের ধর্ম পালনের অধিকার ও স্বাধীনতায় বাধা দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি পর্দার বিধানকে উগ্রবাদ মনে করেন, যা ইসলামের প্রতি তার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশের নামান্তর। পর্দা ইসলামে ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়। এটি মুসলিম নারীদের জন্য একটি আবশ্যকীয় ধর্মীয় কর্তব্য। ধর্মীয়ভাবে এর রেফারেন্স খুব শক্তিশালী এবং অথেনটিক। এমনকি পর্দার বিষয়টি নিছক পোশাকের ইস্যুও নয়। তাই ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকারের ইস্যু হিসেবে এটিকে দেখতে হবে। নামাজ-রোজায় যেমন বাধা দেয়ার সুযোগ নেই, তেমনি কারো পর্দা পালনের অধিকারকেও অস্বীকার করা যেতে পারে না। ব্যক্তিজীবনে কে কতটুকু ধর্ম পালন করল এর চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, অন্যের ধর্ম পালনে হস্তক্ষেপ বা বাধা প্রদান গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু গত মে মাসের শেষদিকে হাইকোর্টের আপিল বিভাগ ঢাবির বাংলা বিভাগের একটি বিতর্কিত নোটিশ সমর্থন করে বলেন, ‘শিক্ষকরা পিতার সমতুল্য। সে জন্য পরিচয় শনাক্তকরণের জন্য তারা ছাত্রীদের মুখমণ্ডল দেখতে পারেন।’ ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হলে এ ক্ষেত্রে কোনো সমাধান আসার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। ফলে আপিল বিভাগের বক্তব্যের পর ইস্যুটি এখন আরো জটিল হয়ে উঠেছে।

বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা একটি অতীব স্পর্শকাতর ইস্যু। এমনকি সা¤প্রতিককালে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের কোনো কোনো প্রদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও হিজাব-নেকাব-বোরকা নিষিদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে এবং তা নিয়ে দেশটিতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে, যদিও এর পেছনে হিন্দুত্ববাদীদের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল বলে ধারণা করা হয়। অন্য দিকে, ইউরোপের ডজনখানেক দেশেও নানা অজুহাতে আইন করে হিজাব-নেকাব ব্যান্ড করা হয়েছে এবং সেটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে। ২০১৪ সালে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত এক রায়ে নেকাবের ওপর সাধারণ নিষেধাজ্ঞা দিলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছিল, ‘এই রায় ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক এবং গভীরভাবে ক্ষতিকর। রায়টি এই বার্তা দেয় যে, জনসমক্ষে ধর্মীয় বিশ^াস প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নারীরা স্বাধীন নয়।’

ফ্রান্সে নেকাব ব্যান্ড করার ক্ষেত্রে কথিত ‘জননিরাপত্তা’ ছাড়াও আরেকটি যুক্তি দেয়া হয়েছিল যে, মুসলিম মেয়েদের হিজাব-নেকাব পরতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করেছে, তাদের গবেষণায় জোরজবরদস্তির এমন কোনো প্রমাণ ফ্রান্সের মুসলিম স¤প্রদায়ের মধ্যে পাওয়া যায়নি (১ জুলাই-২০১৪, সংস্থাটির ওয়েবসাইট)। নেকাব নিষিদ্ধকরণে ফ্রান্স সরকারের আরেকটি যুক্তি ছিল, ফ্রান্সের গণতান্ত্রিক সমাজের অখণ্ডতা ও সহাবস্থান উন্নত করা। কিন্তু ফ্রান্সের যুক্তিসমূহ প্রত্যাখ্যান করে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিটি এই মত দেয় যে, ‘নেকাবের ওপর ফ্রান্সের নিষেধাজ্ঞা ধর্মীয় কারণে নেকাব পরিহিত নারীদের অধিকার দলন করে।’

এ ছাড়া, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিটি স্পষ্ট করে বলেছে, ধর্মীয় প্রার্থনা বা ইবাদতের ধারণার মধ্যে ধর্মীয় চিহ্নের প্রদর্শন এবং সেসব চর্চার মধ্যে স্বতন্ত্র পোশাক ও হেডকভারিংও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জাতীয় বিদ্যাপীঠে নেকাব পরার স্বাধীনতা খর্ব করার প্রবণতা খুবই উদ্বেগজনক। পর্দা কোনোভাবেই মানুষের চাপিয়ে দেয়া বিধান বা সংস্কৃতি নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে ইসলামের ফরজ বিধান। তাই এটি ধর্মীয় স্বাধীনতা বা ধর্মীয় অধিকার চর্চার ডিসকোর্সের মধ্যে পড়ে। কেউ যদি ধর্মীয় বিধান মেনে পর্দা করতে চায়, তার সে সুযোগ পাওয়াটা তার ধর্মীয় স্বাধীনতারই অংশ। আপিল বিভাগ শিক্ষকদের ‘পিতার সমতুল্য’ বললেও এমন কিছু শিক্ষক রয়েছেন যারা নিজ ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করে বিকৃতমনষ্কতার পরিচয় দেন। শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়নের অসংখ্য অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সে কারণে গায়রে মাহরাম হিসেবে শিক্ষকদের সামনেও পর্দা করার গুরুত্ব রয়েছে। আর হিজাব-নেকাব পরার কারণে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অসংখ্য নারী শিক্ষার্থী তাদের কোনো না কোনো শিক্ষকের কটূক্তি ও অপমানজনক কথাবার্তার শিকার হয়েছেন। এই লেখকের স্ত্রীও ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষার পর ভাইভাতে কলা অনুষদের তৎকালীন ডিন (বর্তমানে ভিসি) অধ্যাপক আখতারুজ্জামান সাহেবের কটাক্ষের শিকার হন, শুধু বোরকা পরার কারণে। পরিচয় শনাক্তকরণই যদি মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বোরকা ও পর্দা নিয়ে বারবার তির্যক মন্তব্য কেন!

বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু পর্দা বা হিজাবই নয়, সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর সেক্যুলারের গাত্রদাহের কারণ। অথচ এ অঞ্চলের গরিব চাষাভুষা মুসলমানদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রসার ও উন্নতির লক্ষ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। নবাব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকরা সা¤প্রদায়িক এলিট হিন্দুদের নানা ষড়যন্ত্র ও বাধা ডিঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনে সক্ষম হন। অথচ আজকে এই বিশ^বিদ্যালয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন; বাঙালি জাতিবাদী সেক্যুলারিজমের আড়ালে ইসলাম খেদানোর প্রবণতা দেখা যায়। তবে বাংলায় রেনেসাঁ ও সেক্যুলারিজমের নামে ‘ইসলাম খেদাও’ নীতি আজকে নতুন নয়, এর শিকড় প্রোথিত উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষিত বাংলার হিন্দু রেনেসাঁসের গর্ভে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]