ঢাকার চারপাশের নদীতে অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা ১৬টি ব্রিজ ভেঙে পুনর্নির্মাণ করা হবে। এতে অন্তত ১৬শ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হবে সরকারকে। এসব ব্রিজ নির্মাণের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের ভুলের কারণেই মূলত এই মোটা অঙ্কের মাশুল দিতে হচ্ছে।
তাই সরকারের সংশ্লিষ্টরা এ দায় এড়াতে পারে না। অপরিকল্পিত এসব ব্রিজের নকশা প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অন্যথায় ভবিষ্যতেও একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এছাড়া এসব ব্রিজ তৈরি করতে আগে যে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়েছিল, সেগুলো ভাঙা হলে সেই অর্থের পুরোটাই এক রকম ‘পানিতে’ পড়বে।
আরও জানা গেছে, ১৬টির বাইরে পুনর্নির্মাণের তালিকায় বাবুবাজার ব্রিজ যুক্ত হওয়ার কথা। সেটি কার্যকর হলে ভুলের মাশুল দ্বিগুণ গুনতে হবে। এই ব্রিজটি ভেঙে পুনর্নির্মাণ করতে ইতোমধ্যেই সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার চারপাশের নৌপথের উচ্চতা বিবেচনা না করে নির্মাণ করা ছোট-বড় ১৬টি ব্রিজের কারণে নৌপরিবহণ চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকা শহরের সড়কের ওপর চাপ কমাতে বৃত্তাকার নৌপথ সচল করার উদ্যোগও ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এমন পরিস্থিতে গত রোববার নৌচলাচলের উপযোগী উচ্চতা নিশ্চিত করতে ত্রুটিপূর্ণ এসব ব্রিজ ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, ঢাকার চারপাশের নদ-নদী ও মেঘনা নদীর দখল-দূষণ ও নাব্য ফেরানো সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে সরকারের ব্যয় হবে অন্তত ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী এবং ওই মন্ত্রিসভা কমিটির প্রধান মো. তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর ওপরের যেসব বিজ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলো নির্মাণের সময় নৌচলাচলের কথা ভাবা হয়নি। সে কারণে এখন এ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হচ্ছে। সে সময় এসব ভাবা উচিত ছিল।’
তিনি বলেন, ‘উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন কাজ করছে। তারই অংশ হিসেবে এসব ব্রিজ টেকসই করে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আমরা এসব নদ-নদীর পারের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে সেসব জায়গা ব্যবহার উপযোগী করছি। পানির দূষণ প্রতিরোধ করে এসব নদ-নদীর পানি ব্যবহার উপযোগী করতেও কার্যক্রম চলছে। সামগ্রিক বিষয় চিন্তা করে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে তারই আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।’
সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভা কমিটির ওই বৈঠকে উল্লিখিত ব্রিজগুলো যদি সংস্কার করে নৌচলাচল উপযোগী করা সম্ভব হয়, সেটিও ভেবে দেখতে বলা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যমান ব্রিজগুলো অদূরদর্শী পরিকল্পনায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এজন্য ভবিষ্যতের চিন্তা করে এ ব্রিজগুলো ভেঙে নতুন করে তৈরি করা ছাড়া বিকল্প নেই।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অদূরদর্শী পরিকল্পনায় বাস্তবায়িত ব্রিজগুলোর মধ্যে রয়েছে, আমিন বাজার বেইলি সেতু, আশুলিয়া সেতু, প্রত্যাশা সেতু, কামারপাড়া সেতু-১, কামারপাড়া সেতু-২, টঙ্গী সড়ক সেতু-২, টঙ্গী সড়ক সেতু-৩, টঙ্গী রেল সেতু-১, টঙ্গী রেল সেতু-৩, তেরমুখ সেতু, পূর্বাচল সেতু, ইছাপুরা সেতু, চনপাড়া সেতু, কাউন্দিয়া সিন্নিরটেক সেতু, রুস্তমপুর সেতু এবং উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টর সংলগ্ন দেওয়ান ভেড়িবাঁধ সেতু।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রকৌশলীরা জানান, ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার নৌপথ সচল করতে সরকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর দখল, দূষণ ও নাব্য ফেরানোর কাজ শুরু করেছে। দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম ইতোমধ্যে দেশবাসীর নজর কেড়েছে।
রোববার চারপাশের নদ-নদীর দখল, দূষণ ও নাব্য ফেরানো সংক্রান্ত কমিটির সভার বৈঠকে ১৩টি ব্রিজ ভেঙে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বলছে, এর সংখ্যা ১৬টি।
তাদের মতে, ঢাকার চারপাশে নৌপথের উচ্চতা লঙ্ঘন করে নির্মিত ১৬টি ব্রিজের গড় দৈর্ঘ্য হবে অন্তত ৪০০ মিটার। দুই লেনের এসব ব্রিজ নির্মাণে মিটারপ্রতি খরচ হতে পারে ২৫ লাখ টাকা।
সে হিসাবে প্রতিটি ব্রিজ নির্মাণে খরচ হবে অন্তত ১০০ কোটি টাকা। ১৬টি ব্রিজ নির্মাণে খরচ হবে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকের পর সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সভায় বাবুবাজার ব্রিজ ভাঙার ব্যাপারেও আলোচনা হয়।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সে কথা উল্লেখ করা হয়। তবে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তালিকায় ওই নাম নেই।
এ কারণে পরবর্তী সভায় ব্রিজ ভাঙা, পুনর্নির্মাণ বা সংস্কারের তালিকায় আরও কিছু নাম যুক্ত হতে পারে।
জানতে চাইলে একই বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার চারপাশের নদ-নদীতে আগে যেসব ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে, অনেকগুলোর ক্ষেত্রে নৌচলাচলের কথা বিবেচনা করা হয়নি। যে কারণে সেগুলো এখন পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে দুটি ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত, ব্রিজ নির্মাণকারী সংস্থাগুলো নৌচলাচলের কথা বিবেচনা করেনি। দ্বিতীয়ত, সরকার বা বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে নৌপথ সচল করার ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ায় কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে বিআইডব্লিটিএ’র চেয়ারম্যান বলেন, ‘সদরঘাট পর্যন্ত যেসব নৌপরিবহন চলাচল করে তেমন নৌপরিবহন বৃত্তাকার চলাচল করুক, আমরা সেটা নিশ্চিত করতে চাই। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে টঙ্গী রেল ব্রিজ। কেননা ওই ব্রিজ উঁচু করা হলে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের উচ্চতা দ্বিতীয়তলার সমান হয়ে যাবে। এ কারণে এটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তবে আশুলিয়া পর্যন্ত নৌপথ কার্যকরভাবে সচল করা সম্ভব। আর বাকি অংশে ওয়াটারট্যাক্সি এবং অন্যান্য নৌপরিবহন চলাচল করবে।’
তিনি আরও জানান, ‘বাবুবাজার ব্রিজের উচ্চতাও অনেক কম। দ্বিতীয় শ্রেণির নৌব্রিজ হিসাবে ওটা নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। আমরা বাবুবাজার ব্রিজকে পুনর্নির্মাণের তালিকাভুক্ত করতে সুপারিশ করব। কেননা আশুলিয়া পর্যন্ত ভারী নৌযান চলাচল নিশ্চিত করতে হলে, এটা বাধা হতে পারে। এটা নিয়েও ভাবা হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর যেসব ব্রিজ এখন ভাঙতে হচ্ছে এসব অদূরদর্শী চিন্তার ফসল। এসব ব্রিজ নির্মাণের সময় এসব বিষয় চিন্তা করা হলে এখন নতুন করে এত টাকা খরচ করতে হতো না। এটা শুধু ঢাকার নদ-নদীর ক্ষেত্রে হয়েছে এমন নয়, সারা দেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে।’
তিনি বলেন, ‘এরপরও ঢাকার চারপাশের নদ-নদীকে ঘিরে বৃত্তাকার নৌপথ সচল করতে সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, এটি ইতিবাচক। আমরা আশা করব, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ভালো করে যাচাই-বাছাই করে যেন বাস্তবায়ন করা হয়। তাহলে ভবিষ্যতে এমন ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে না।’
স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, ‘নদীতে কোনো ব্রিজ নির্মাণ করলে নৌচলাচল যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেটা আমলে নিয়েই করতে হয়। কিন্তু ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর অনেক ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে এটা মানা হয়নি। এটা দুঃখজনক ব্যাপার।’
তিনি বলেন, ‘সড়কে যদি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে ফায়ার সার্ভিস বা ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী উচ্চতা না রাখা হয়, তাহলে তো সেটা গ্রহণযোগ্য ব্রিজ হবে না। একইরকমভাবে নৌপথের ক্ষেত্রে নৌচলাচলের উপযোগী পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। এটা তো যারা ব্রিজ নির্মাণ করেছে, তাদের বুঝে করতে হবে। কিন্তু যারা এসব নিয়ম না মেনে এসব ব্রিজ নির্মাণ করেছে, তাদের অদূরদর্শিতার কারণে সরকারকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিহ্নিত ব্রিজগুলো না ভেঙে সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করা যায় কিনা, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। তাহলে জনগণের অর্থের অপচয় কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হবে।’
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সালেহ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারের মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক এলজিইডির ব্রিজগুলো সংস্কারের লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ধাপে ধাপে এলজিইডির সব ব্রিজ পুনর্নির্মাণ করে সংস্কার উপযোগী করা হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর ব্রিজগুলোর গড় দৈর্ঘ্য হবে অন্তত ৪০০ মিটার। দুই লেনের এসব ব্রিজ নির্মাণ করতে মিটারপ্রতি খরচ হতে পারে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। চার লেনের ব্রিজ হলে সেগুলোর খরচ আরও বাড়বে। তবে এসব ব্রিজ সাধারণত দুই লেনের হয়ে থাকে।’
এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুস সবুর যুগান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রিসভা কমিটির নির্দেশনার আলোকে ঢাকার চারপাশের নদ-নদীতে নৌচলাচলে বাধা সৃষ্টিকারী সওজের ব্রিজগুলো ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হবে। সে লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করা হবে।
ধাপে ধাপে এসব বি জ নৌচলাচলের উপযোগী করা হবে। তিনি আরও বলেন, এসব ব্রিজ পুনর্নির্মাণে দুই লেনের ক্ষেত্রে প্রতিমিটার ২৫ লাখ টাকা এবং চার লেনের ক্ষেত্রে প্রতিমিটার ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। তবে আমি যতটুকু জেনেছি ব্রিজগুলোর অধিকাংশই দুই লেনের হবে।