- মো: এমদাদুল ইসলাম
- ১৩ মার্চ ২০২৩, ২১:২০
দেশে প্রায় সর্বত্রই ত্রুটিযুক্ত ঘরবাড়ি, ইমারত ও অবকাঠামো নির্মাণ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে অগ্নিদুর্ঘটনা, বিস্ফোরণ, ধস ঘটছে। ভূমিকম্প হলে তো খুবই করুণ পরিস্থিতি হবে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মোতাবেক, ঢাকার মহাপরিকল্পনা/ড্যাপ মোতাবেক কোনো বসবাসযোগ্য জমির ওপর যথানিয়মে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র গ্রহণ এবং প্রস্তাবিত ইমারতের স্থাপত্য ও কারিগরি ডিজাইন তৈরি ও অনুমোদন করিয়ে উপযুক্ত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে এবং কারিগরি লোকজনের তত্ত্বাবধানে ইমারত নির্মাণ বাধ্যতামূলক এবং ইমারতের নির্মাণকালে সবপর্যায়ে বিল্ডিং কোড অনুসরণও বাধ্যতামূলক।
কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই এর ব্যত্যয় ঘটছে অর্থাৎ অনেকে রাজধানী ঢাকায় বসবাস করেও এসবের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ও অনুমোদন না নিয়েই ইমারত নির্মাণ করেছেন বা এখনো করেছেন। অন্য দিকে যারা অনুমোদন নিয়ে ইমারত নির্মাণ করে, তাদের বেশির ভাগও আবার প্রায় ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সমতলে (horizontal) ও ঊর্ধ্বমুখী (vertically) ইমারতের সম্প্রসারণ এবং বিধি/কোডের পরিপন্থী করে ও কারিগরি লোকজনের অনুপস্থিতিতে ইমারত নির্মাণ করছেন। তাছাড়া যেভাবে অনুমোদন লাভ করে, তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ইমারতের বেজমেন্ট ফ্লোরসও (যা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নির্মিত) যেন অন্যভাবে ব্যবহার করা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।
প্রচলিত নিয়মে বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড অনুসরণে যথাযথভাবে ইমারত নির্মাণ শেষে অথবা ভবনের আংশিক নির্মাণ করে তা ব্যবহার করা বা ভাড়া দেয়ার আগে নকশা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ থেকে ইমারতের বসবাসযোগ্যতার সনদ (Occupancy Certificate) গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে খুবই কম সংখ্যক ইমারতের মালিক/রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান এই সনদপত্র গ্রহণ করেন। এর প্রধান কারণ- যথাযথভাবে অর্থাৎ অনুমোদন মোতাবেক ইমারত নির্মাণ না করা, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা। এধরনের প্রায় ইমারতই ‘ত্রুটিযুক্ত’ ও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত! এতে বড় সমস্যা দেখা দেয়- যদি কখনো কোনো কারণে এসব ইমারতে আগুন লাগে, বিস্ফোরণ ঘটে বা ধসের সৃষ্টি হয়। কারণ, তখন তাৎক্ষণিকভাবে এসব ইমারতের অনুমোদনের তথ্য বা অনুমোদিত নকশা পাওয়া যায় না; এসব ইমারতে ডিজাইন মোতাবেক অগ্নিনির্বাপণ ও অগ্নিপ্রতিরোধের তথ্য মেলে না এবং এ বিষয়ে কিছু লাগানো বা স্থাপন করা হলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর থাকে না। অন্যদিকে এসব ইমারতের নিচে বা আশপাশে পয়ঃপ্রণালী ও বিদ্যুৎ লাইন বা গ্যাসের লাইন ও লিকেজগত বিষয়ও বড় সমস্যা। এই অবস্থায় ঢাকায় বা আশপাশে যদি বড় আকারের ভূমিকম্প হয় তাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
আগেকার দিনে বেশির ভাগ মানুষই স্থানীয় বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী দিয়ে নিজ নিজ তত্দাবধানে ঘরবাড়ি বা ইমারত নির্মাণ করতেন, আর এখন সেখানে প্রায় ক্ষেত্রেই নানা ধরনের এমনকি বর্জ্য ((devris), মিশ্র বা হালকা নির্মাণসামগ্রী দিয়ে স্থানীয় কনট্রাকটর বা ডেভেলপাররাই কোনো রকমে ইমারত নির্মাণ করে থাকেন। সঙ্গত কারণে এখানেই সৃষ্টি হয় যতসব সমস্যা। কারণ, সচরাচর বড় বা ভালো কনট্রাকটর বা ডেভেলপাররা অনুমোদিত ডিজাইন অনুসারে এবং গুণগতমান বজায় রেখে কম-বেশি মোটামুটি ভালো ইমারত নির্মাণ করে থাকেন, কিন্তু যারা ছোট ঠিকাদার বা ওয়ান-টাইম ডেভেলপার, তারা খুব কম ক্ষেত্রেই যথাযথ নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার ও বিল্ডিং কোড মেনে ইমারত নির্মাণ করেন। ফলে এসব ইমারতে দুর্ঘটনা (অগ্নিদুর্ঘটনা, ফাটল ধরা, ধস ইত্যাদি) ঘটে। আবার অনেক সময় কিছু ইমারতে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা অপব্যবহারের কারণেও বিস্ফোরণ বা আকস্মিক ধস ঘটে বসে- যা সাম্প্রতিককালে ঘটেছে সায়েন্স ল্যাবে, ফুলবাড়িয়ার সিদ্দিকবাজার ইত্যাদি এলাকায়।
লক্ষ্য করা গেছে, ছোটখাটো ও অখ্যাত রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী বা দুর্বল ঠিকাদারের নির্মিত প্রায় ইমারতই তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ- কারণ এদের প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে- অনেক লাভ করা। এজন্য তারা ইমারতের sub-structure নির্মাণে অনেক ফাঁকি দেয়- যেমন ডিজাইন মোতাবেক পাইলিং না করা, ঠিকমতো ফাউন্ডেশনের কাজ না করা, ব্যবহার অনুপযোগী বেজমেন্ট তৈরি করা ইত্যাদি। তারা super-structure অর্থাৎ কনক্রিটে রড-সিমেন্ট কম দেয়, ভালো মানের খোয়া ও ইট ব্যবহার করে না এমনকি ভালো করে প্লাস্টার এবং কিউরিংও করে না। একই অবস্থা MEP works এর ক্ষেত্রেও অর্থাৎ তারা কোনো রকমে ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল ওয়্যারিং, ফিটিংস লাগায় এবং সেনেটারি কাজও ঠিকমতো করে না! এসব নানা কারণে একটি ইমারত নির্মাণের পর থেকেই এটি ‘ত্রুটিযুক্ত’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ইমারত হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রাতে ঢাকার বনেদি এলাকা গুলশানের ১০৪ নং সড়কে একটি ভবনে আগুন লাগার পর সেটির বিভিন্ন ফ্লোর থেকে লাফিয়ে পড়ে দু’জনের মৃত্যু ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। ইমারতটিতে আগুন লাগার পর অগ্নিনির্বাপণের দায়িত্বে থাকা ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল সার্ভিস (FSCD) এর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ করা হয় যে, এই ভবনটি ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত। যেখানে ফায়ার এক্সিট ও ফায়ার অ্যালার্ম নেই, হাইড্রেন্ট নেই ইত্যাদি আরো অনেক কিছুর ঘাটতি রয়েছে। ইমারতটিতে আগুন লাগার কারণসহ সার্বিকভাবে বিষয়টি তদন্তের জন্য ঋঝঈউ-এর অধীনে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপর দিকে রাজউক থেকে বলা হয় যে, এটি একটি অত্যাধুনিক ইমারত এবং ইমারতটির ব্যবহারের আগে এর বসবাসযোগ্য সনদও নেয়া হয়েছে অর্থাৎ পরস্পরের মধ্যে দায় এড়ানোর খেলা।
প্রসঙ্গক্রমে এর আগে বিভিন্ন সময়ে নগরীতে আরো যত দুর্ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় প্রতিটির ওপর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, কিন্তু কখনো কোনো তদন্ত কমিটির ফাইন্ডিংস, সুপারিশ ইত্যাদি আজ অবধি স্পষ্টভাবে কোনো পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের অপরাধে ঋঝঈউ থেকে কখনো কোনো ইমারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও শোনা যায়নি! পুরান ঢাকার নিমতলী এবং চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ২০০-২৫০ মতো মানুষ মারা যাওয়ার পরও ওই দু’টি তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। ওই অগ্নিদুর্ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিকাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও গোডাউন ঢাকার বাইরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যা আজও কার্যকর হয়নি। বরং অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে এসব পুড়ে যাওয়া ইমারতে আবারও বসবাস এবং ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
ঘরবাড়ি ও ইমারতে আগুন লাগা বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটা নতুন নয়। বিভিন্ন কারণে বিশ্বের সর্বত্র (উন্নত ও অনুন্নত সব দেশেই) এমনকি সম্পূর্ণভাবে সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ইমারত এবং স্থাপনায়ও আগুন লাগে এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তবে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে কিভাবে বা কোত্থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটল, কিভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ল, কত জানমাল ক্ষতিগ্রস্ত হলো ও পরবর্তী করণীয়- এসব বিষয় পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে আজ অবধি এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি!
ইদানীং যেকোনো ইমারতের উল্লেখযোগ্য অপব্যহার হলো- ইমারতে বেজমেন্ট নির্মাণ করে তা অন্য ব্যবহারে নিয়ে যাওয়া। একইভাবে ইদানীং কম-বেশী সব অ্যাপার্টমেন্ট বা অফিস স্পেসে নানা ধরনের অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক কাজসহ অনেক ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয়- যার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে ইমারতের স্থাপতিক ও গ MEP (মেকানিক্যাল-ইলেকট্রো ও প্লাম্বিং) কাজের। কিন্তু এসব কাজ যথাযথ ব্যবস্থাপনায় ও নির্মাণসামগ্রী দিয়ে এবং অগ্নিপ্রতিরোধকভাবে করা হচ্ছে বা হয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ এবং সনদ প্রদান বা প্রত্যায়ন করার জন্য দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এমনকি রাজধানী ঢাকায়ও নেই!
ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল ডিজাইন ইমারতের একটি অপরিহার্য দিক, বিশেষ করে ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমের ডিজাইন ইমারতের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা এবং মঙ্গল নিশ্চিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান ন্যাশনাল ফায়ার প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (NFPA) এর মতানুসারে, ইলেকট্রিক্যাল কাজের ত্রুটি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবাসিক আগুনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ। দৃশ্যত বাংলাদেশেও অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম কারণ হলো- ইলেকট্রিক্যাল শর্টসার্কিট। একটি পরিকল্পিত ইলেকট্রিক্যাল ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ এই বিপদগুলো অনেকাংশে প্রতিরোধ করতে এবং ইমারত ও এর বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্ট অথরিটির অনুপস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরই (FSCD) হচ্ছে- এই কাজের জন্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এজন্য ক্ষেত্রমতো ছয় বা দশ তলার উঁচু যেকোনো ইমারত বা অন্য সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণের পূর্বে FSCD এর ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে FSCD তাদের ছাড়পত্র প্রদানের পূর্বে প্রতিটা প্রস্তাবিত ইমারতের সাইট পরিদর্শন করে এবং তাদের নিজস্ব লোকজন বা নিয়োজিত উপদেষ্টাদের দ্বারা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার সমুদয় নকশা প্রণয়ন করে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শর্তারোপ করে ছাড়পত্র প্রদান করে থাকে। সে মোতাবেক ইমারতের নকশা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ (যেমন ঢাকায় রাজউক, চট্টগ্রামে চউক ইত্যাদি) FSCD প্রণীত অগ্নিনির্বাপণ নকশা ও শর্তাধীনে ইমারতের নকশা অনুমোদন করে থাকে। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই FSCD এসব ইমারতের নির্মাণকালে সেখানে তাদের দেয়া ছাড়পত্র শর্ত মোতাবেক ইমারতটি নির্মিত হচ্ছে কিনা তা দেখতে যায় অর্থাৎ উল্লেখযোগ্য ইমারতই নির্মিত হয়/হচ্ছে FSCD বা MEP বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধান ছাড়া।
একই অবস্থা রাজউক বা চউকের ক্ষেত্রেও কখনো এসব কর্তৃপক্ষের কোনো প্রকৌশলী, ইমারত পরিদর্শক বা অথরাইজড অফিসাররা নির্মাণাধীন কোনো ইমারত পরিদর্শন করতে গেছেন কিনা সন্দেহ। বলতে গেলে এখনো দেশে এ ধরনের কোনো পদ্ধতিও গড়ে ওঠেনি! এমনকি বিল্ডিং কোডে তা বলা থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হয়। কনট্রাকটর/ডেভেলপারের সাইট প্রকৌশলীদের ঘন ঘন সাইট পরিবর্তনের কারণেও কাজের মান এবং তদারকির ধারাবাহিকতা থাকে না।
এই অবস্থায়, কোনো ইমারতে দুর্ঘটনা ঘটলে শুরু হয় পরস্পরের মধ্যে দোষারোপের খেলা বা Blame Game. যেমন কয়েক বছর আগে ঢাকার পান্থপথে ‘বসুন্ধরা সিটি সেন্টারে’ আগুন লাগার পর FSCD এর একই রকম কথা ছিল- যদিও বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ দাবি করেন যে, ওই ইমারতে পুরো ফায়ার ডিজাইন ও বাস্তবায়ন একটি উপযুক্ত বিদেশী প্রতিষ্ঠানের তৈরি ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো- এভাবে ঢাকায় প্রতিটা ইমারতে অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রে FSCD আগেভাগেই তাদের দায়মুক্তি করে নেয়!
অথচ গুলশানের ১০৪ নং সড়কে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক থেকে বলা হয় যে, এই ইমারতটি বিধি ও কোড অনুসরণে নির্মিত হয়েছে এবং ভবনের মালিক রাজউক থেকে Occupancy Certificate গ্রহণ করেছেন। তাই এই ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণে প্রশ্ন ওঠে- FSCD বিবেচ্য ইমারতটির নির্মাণে ছাড়পত্র দেয়ার পর কখনো তারা আর এই ইমারতটির ইন্টেরিয়র নির্মাণসামগ্রী তথা MEP কাজ বিশেষ করে অগ্নিনির্বাপণের কাজ পরিদর্শন করেছে কিনা? যেভাবে বিশ্লেষণ না করেই FSCD বসুন্ধরা সিটিতে আগুন লাগার পর ওই ইমারতটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে দোষ দিয়ে বসে।
আসলে দেশে যথাযথভাবে ও টেকসই প্রক্রিয়ায় ইমারত নির্মাণের লক্ষ্যে আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে বিশেষ করে ঢাকায় অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ((BNBC-1993) প্রণীত হয়। দুঃখের বিষয়-বিগত ত্রিশ বছরেও এই কোডটির কার্যকরণে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা হয়নি। ২০১৩ সালে সাভারে ‘রানা প্লাজা’ ধসে প্রায় ১৫০০ শ্রমিক নিহত হওয়ার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত (সুপ্রিম কোর্ট) দেশব্যাপী এই কোডটির কার্যকরণে একটি শক্তিশালী কমিশন বা কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ দেন, কিন্তু আজ অবধি এই নির্দেশটিও কার্যকর হয়নি। ইতোমধ্যে এই কোডটিকে আবার সংস্কার করে BNBC-2020 নামে জারি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানের অভাবে এটি এখনো একটি optional document হিসেবেই রয়ে গেছে!
নব্বই এর দশকের শেষ দিকে এক সরকারি আদেশের মাধ্যমে রাজউককে ঢাকায় এই কোড বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এজন্য রাজউকে আজ অবধি এতদবিষয়ে কোনো অভিজ্ঞ প্রকৌশলী বা বাড়তি কোনো জনবল দেয়া হয়নি।
বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিল্ডিং কোডে (BNBC) ইমারতের শ্রেণী-বিন্যাশ অনুসারে ডিজাইন ও তদারকির জন্য স্নাতক স্থপতি, প্রকৌশলী ও অপরাপর পেশাজীবিদের উপর দায়িত্ব দেয়া থাকলেও প্রায়ক্ষেত্রে নকশা অনুমোদনের পর ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থপতি ও প্রকৌশলীরা আর এই নির্দিষ্ট বা বিবেচ্য ভবনের নির্মাণের তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন না। এজন্য একটি ইমারতের নির্মাণ শেষে এর Occupancy Certificate পেতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
সম্প্রতি তুরস্কে ভূমিকম্পের পর সেখানে হাজার-লাখ ইমারত মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ে। অনেক শক্তিশালী ইমারতও ভেঙে পড়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা গেছে এবং প্রায় আড়াই লাখ ইমারত ভেঙে পড়ছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতঃপর আইন-নিয়ম না মেনে এসব ইমারত নির্মাণের জন্য সেখানে প্রায় ১৫০ জন ঠিকাদার/ডেভেলপারকে আটকও করা হয়েছে। আমরাও ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকায় বসবাস করছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা কারো কোনো মাথা ব্যথাই নেই!
এখন অবস্থা এমনি যে, ঢাকা মহানগরী এলাকায় প্রকৃত কত ঘরবাড়ি, বহুতল ইমারত ও স্থাপনা/অবকাঠামো আছে তার কোনো পরিসংখ্যান রাজউক বা অন্য কোনো সংস্থার কাছেও নেই! আবার যা ঘরবাড়ি বা ইমারত আছে তার নব্বই ভাগেরও বেশি নাকি অবৈধভাবে বা অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত হয়েছে বলে প্রকাশ! রাজউকের এক পরিসংখ্যানে বলা হয় যে, বর্তমানে ঢাকায় মাত্র ৪.৬% ইমারতের নকশা অনুমোদিত। অপর দিকে গৃহসংস্থান অধিদফতর (HBRI) এর মতে ঢাকায় প্রায় ষাট ভাগ ইমারতই বিভিন্নভাবে ঝুঁকিপূর্ণ! আর ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরের মতে- দেশের সব ইমারতই অগ্নিনির্বাপণের দৃষ্টিতে কম-বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। তাহলে আমরা কোথায় বসবাস করছি?
ঢাকায় আইনানুগভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত ও অবকাঠোমো চিহ্নিত করা এবং অপসারণের দায়িত্ব উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওপর। পুরান বা নতুন ঢাকা এমনকি নগরীর আশপাশে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ী ও ইমারত রয়েছে, কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা কমই শোনা গেছে। কয়েক বছর আগে বনানীর ১১ নং সড়কে ‘এফ আর টাওয়ারে’ আগুন লাগার পর ওই ইমারতটি DNCC কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে তা পরিত্যক্ত করে রাখা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একইভাবে কয়েক বছর আগে ঢাকা নিউমার্কেট এলাকায় ‘চাঁদনী চক’ মার্কেটসহ আরো কয়েকটি মার্কেট ও স্থাপনাকে সিটি করপোরেশনস কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত ঘোষণার পরও এখনো এসব ইমারত/স্থাপনায় দেদার ব্যবসা-বাণিজ্য চলে আসছে।
প্রকৃত পক্ষে, এখন দেশের নগর এলাকায় কোনো একটি ইমারতে আগুন লাগা ও ত্বরিত ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো- Flamable (দাহ্য) সামগ্রী দিয়ে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা। নিয়ম হলো- অবশ্যই সব ইন্টেরিয়রের কাজ Inflamable Materials বা অদাহ্য বস্তু দিয়ে করা এবং এ কাজের জন্য প্রত্যয়নের ব্যবস্থা থাকা অথচ বর্তমানে এজন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় রাজউকের অধীনে Urban Resiliance Project (URP) শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় কিছু সমীক্ষা ও Case Study হয়েছে। আমি নিজেও এই কাজটির সাথে কিছু দিন সংযুক্ত ছিলাম। কিন্তু এই প্রকল্পের সুপারিশমালার কার্যকরণ এখনো শুরু হয়নি! এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নেরও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না!
যেমন, এই প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক এক সমীক্ষায় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ৩১৪টি বহুতল ইমারতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এসব ভবনের কোনোটি কোনো মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ এবং এসব ইমারতকে strengthening/retrofitting করে ঠিক করা সম্ভবপর হবে কিনা, তার কোনো কাজ শেষ করা যায়নি! অনুরূপভাবে ঢাকার কোনো এলাকার মাটিতে বহুতল ইমারত বা বড় স্থাপনা নির্মাণযোগ্য তাও বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু এই কাজও পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়নি! একইভাবে ঢাকায় নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়াকে উন্নত (ডিজিটাইজেশন) করার জন্য Electronic Construction Permitting System (ECPS) নামে যেসব software তৈরি, বিধিমালা প্রণয়ন এবং hardware সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেগুলোও প্রকল্পের গোডাউনে পড়ে আছে।
অপর দিকে, দীর্ঘদিন পর ঢাকার উন্নয়নে নতুন ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) প্রণীত হয়েছে, কিন্তু এর বিভিন্ন প্রস্তাবনা নিয়ে প্রচণ্ড আলোচনা-সমালোচনার মুখে বর্তমানে এটির সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হলো- এই ড্যাপে ঢাকায় অবৈধ, অননুমোদিত বা অনুমোদনের ব্যত্যয় করে নির্মিত ইমারতের জরিমানা তার অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য ইতোমধ্যে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে! যদি এর প্রতিটা ইমারতকে জরিমানা দিয়ে নিয়মিত করা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অচিরে ঢাকার সর্বনাশ ঘটবে।
লেখক : সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক