শুভ্র দেব
১১ নভেম্বর ২০২৫, মঙ্গলবার 
গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রায় ঘিরে ঢাকায় চোরাগোপ্তা হামলা শুরু হয়েছে। টানা কয়েকদিন ধরে বেশ কিছু স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে চোরাগোপ্তা হামলা করছে দুর্বৃত্তরা। বেশ কিছু স্থাপনার ভেতরে-বাইরে ককটেল বিস্ফোরণ ও ধারাবাহিকভাবে কিছু বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। যদিও এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে ছোট ছোট এসব ঘটনা থেকে বড় ধরনের হামলা ও নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক ও প্রস্তুত থাকার কথা জানালেও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে একের পর এক এত ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তাদেরও শনাক্ত করা যাচ্ছে না। চোরাগুপ্তা হামলা ও নাশকতার আশঙ্কায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ দুর্বৃত্তরা কখন কোথায় কীভাবে হামলা করছে সেটির আগাম কোনো তথ্য মিলছে না। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়েই তারা সুবিধাজনক স্থানে বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগ করছে। সোমবার ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অন্তত ১২টি ককটেল বিস্ফোরণ ও তিনটি অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গতকাল ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় ২৮ বছর বয়সী একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ওই ব্যক্তি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সদস্য। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার পুলিশের বরাত দিয়ে বলেন, ককটেল বিস্ফোরণের একাধিক ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিশেষ করে কাকরাইলের সেন্ট মেরিজ ক্যাথেড্রাল ও ক্যাথলিক পরিচালিত খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেন্ট যোসেফ স্কুল প্রাঙ্গণে সংঘটিত হামলার ঘটনায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় রায় ঘোষণার দিন ধার্য করাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার স্বার্থে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট বার ভবন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়াও ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনায় নিরাপত্তা শঙ্কায় নিয়মিত নিরাপত্তার চেয়ে আরও বেশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। থানায় থানায় কড়া বার্তার দেয়ার পর থেকে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছেন ওসিরা। প্রতিটি থানায় এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। চেকপোস্ট, টহলের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি থানা এলাকার আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীর তালিকা ধরে ধরে অভিযান পরিচালনা ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে শান্ত মারিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। রাত সাড়ে ৭টার দিকে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বাসটিতে কীভাবে আগুন লেগেছে তা জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বাসের পাশ দিয়ে সাত-আটজন তরুণ হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন হঠাৎ বাসটিতে আগুন ধরে যায়। প্রায় একই সময়ে আগারগাঁও রেডিও স্টেশনের সামনে দুটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মিরপুর শাহ আলী মার্কেটের সামনে তিনটি ও সবুজবাগ এলাকায়ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে সোমবার ভোরের দিকে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা ও শাহজাদপুর এলাকায় দুটি বাসে অগ্নিকাণ্ডের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। দুটি বাসই ভিক্টর পরিবহনের। এদিন সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। উপদেষ্টার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করে দুটি ককটেল নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। তবে এ ঘটনায় কেউ আহত বা হতাহত হয়নি।
সকালে দু’টি মোটরসাইকেলে দুই ব্যক্তি স্যার সৈয়দ রোড, বাড়ি নং- ০৬/০৮ এসে ফরিদা আক্তারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘প্রবর্তনা’-এর ভেতর একটি এবং রাস্তার ওপর আরেকটি ককটেল নিক্ষেপ করে। দু’টি ককটেলই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে আশপাশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। এদিন সকালে ধানমণ্ডিতে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে ধানমণ্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শাহ মোহাম্মদ তারিকুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানান, সকাল ৭টায় ধানমণ্ডির ইব্নে সিনা হাসপাতালের সামনে দু’টি এবং রাপা প্লাজার বিপরীত পাশ থেকে মাইডাস সেন্টারের সামনে আরও দু’টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় মোটরসাইকেল আরোহীরা। ককটেল বিস্ফোরণে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আলামত ও সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এর আগে রোববার রাত ২টা ৪৩ মিনিটে মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, একটি মোটরসাইকেলে করে সাদা পোশাকে দুইজন ব্যক্তি এসে গ্রামীণ ব্যাংকের সামনে দাঁড়ায়। এ সময় তাদের মুখে গামছা বাঁধা ছিল। মুহূর্তের মধ্যেই তারা পরপর দু’টি ককটেল নিক্ষেপ করে মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। এদিকে সোমবার ভোরে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা ও শাহজাদপুর এলাকায় দু’টি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। দু’টি বাসই ভিক্টর পরিবহনের। কে বা কারা বাস দু’টিতে আগুন দিয়েছেন সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, সোমবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে সংবাদ আসে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা ও শাহজাদপুর এলাকায় ভিক্টর পরিবহনের দু’টি বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। পরে আমাদের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে বাসে কীভাবে আগুন লেগেছে তা আমরা জানি না। এতে কেউ হতাহত হয়েছেÑ এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি।
এর আগে শনিবার রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফ স্কুলে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষ থানায় জিডি করেছেন। তবে কে বা কারা স্কুলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সেটি এখনও জানা যায়নি। তারও আগে গত শুক্রবার রাত পৌনে ১১টার দিকে রাজধানী রমনার কাকরাইল এলাকায় অবস্থিত সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল গির্জায়ও দু’টি ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি ককটেল বিস্ফোরিত হলেও আরেকটি অবিস্ফোরিত থেকে যায়। পরে পুলিশ এসে সেটি উদ্ধার করে। এ ঘটনায়ও কেউ হতাহত হয়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে। একই রাতে মিরপুর-২ নম্বর এলাকায় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি বাসে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, টানা কয়েকদিন ধরে দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে চোরাগুপ্তা হামলা চালাচ্ছে। এসব হামলার আলামত মোটেও ভালো না। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা বলে দুর্র্বৃত্তরা এভাবে ছোট ছোট হামলা করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বুঝে পরে বড় হামলা করে। ইতিমধ্যে তারা গীর্জা, স্কুলে, উপদেষ্টার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, একাধিক বাসে আগুন দিয়ে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। তাই এ থেকে বড় হামলা ও নাশকতার শঙ্কা রয়ে যায়।
সূত্রগুলো বলছে, হাসিনার রায় ঘিরে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে অগ্নি সংযোগের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও নড়েচড়ে বসেছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও এ নিয়ে কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার সবই ঢাকা মহানগরে। তাই ডিএমপি’র প্রতিটি থানা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছেন। থানা পুলিশ তৎপর থাকার পরও বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগ হচ্ছে। পুলিশের সূত্র বলছে, কেউ যদি নাশকতা করতে চায় তবে সেটি সবসময় বন্ধ করা যাবে না। একেকটি এলাকার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা সীমিত। দুর্বৃত্তরা রেকি করেই নাশকতা করছে। যেখানে পুলিশের উপস্থিতি নাই সেদিকটাকেই তারা টার্গেট করছে। কারণ ককটেল বিস্ফোরণ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে করা যায়। এছাড়া গান পাউডার দিয়ে বাসে অগ্নিসংযোগ করতে এক মিনিটও সময় লাগে না।









