স্টাফ রিপোর্টার
১৯ জুলাই ২০২৩, বুধবার
দেশে প্রতিমুহূর্তে গণতন্ত্র হরণ ও আইনের শাসন লঙ্ঘন হচ্ছে। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নাই। মানুষের ভোটের অধিকার নাই। দেশের মানুষ গণতন্ত্রের নমুনা দেখেছে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে, কীভাবে একজন নির্বাচনের প্রার্থীকে রাস্তায় ফেলে পিটানো হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয়েছে বর্তমান আওয়ামী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকার প্রকাশ্যে রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করছে অথচ জামায়াত সহ বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মানুষকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে। এজন্য আওয়ামী লীগকে একদিন জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে- এমনটাই দাবি করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা।
বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের উদ্যোগে ‘ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস এন্ড দ্য রুল অব ল’ ইন বাংলাদেশ’- শীর্ষক এক সেমিনারে এ দাবি করেন বক্তারা। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ। বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি এডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকারের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক নকীব মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মু. আব্দুল হান্নান।
বিজ্ঞাপন
প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ।
এডভোকেট আব্দুর রাজ্জাকের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন- ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এডভোকেট এসএম কামাল উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট ইউসুফ আলী, বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট ড. গোলাম রহমান ভূঁইয়া, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সিনিয়র সহ-সম্পাদক এডভোকেট মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সম্পাদক এডভোকেট সাইফুর রহমান, সাবেক সহ-সভাপতি এডভোকেট আব্দুল বাতেন, সাবেক সহ-সম্পাদক এডভোকেট রেজাউল করিম খন্দকার, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক ট্রেজারার এডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক, বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় মানবাধিকার সম্পাদক এডভোকেট শফিকুর রহমান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি এডভোকেট জালাল উদ্দীন ভূঁইয়া প্রমুখ।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ঢুকানো হয়েছে। একটার সঙ্গে আরেকটি সম্পর্ক তেল আর পানির মতো। এটাই এখন রাষ্ট্রে সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র দু’টি বিপরীত জিনিস। ইংল্যান্ডে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয় প্রকাশ্যে। আমেরিকায় ২ মাস আগেই ব্যালট পেপার ছাপানো হয়ে ভোটারদের কাছে পৌঁছানো হয়। দেশে আজ আইনের শাসন ও মানবাধিকার নাই বলেই সর্বত্র সমস্যা দেখা দিচ্ছে। খারাপ আইন দিয়ে ভালো সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তিনি সবাইকে হিউম্যান ডিউটি যথাযথভাবে পালন করার আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, আমরা যদি উন্নত চরিত্রের অধিকারী ও ন্যায়পরায়ণ হই তবে আমরা সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবো। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতে হবে।
প্রবন্ধ উপস্থাপক এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণ নির্বাহী বিভাগের ভয়াবহ ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। দুঃশাসন ও সর্বগ্রাসী মনোভাব শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান দায়মুক্তির সংস্কৃতি কর্তৃত্ববাদী শাসক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন ও নিপীড়ন ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় প্রসিদ্ধ বিধানসমূহ থাকা সত্ত্বেও এদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন একটি দূরবর্তী বিষয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখন অনেক দূরের স্বপ্ন যা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী দল অতীতে প্রায় সকল সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বিগত ১৪ বছরে তিন দফায় ২৬ মাস কারাগারে বন্দি আছেন এবং ৫৫ দিন পুলিশ রিমান্ডে ছিলেন। নায়েবে আমীর, সাবেক এমপি মাওলানা আনম শামছুল ইসলাম বিগত ১৪ বছরে চার দফায় ২৬ মাস কারাগারে বন্দি আছেন এবং ১২ দিন পুলিশ রিমান্ডে ছিলেন। সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বিগত ১৪ বছরে ৭ বছর ৫ মাস কারান্তরীণ রয়েছেন এবং ৩৩ দিন পুলিশ রিমান্ডে থেকেছেন। মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানকে ২০২১ সালে গ্রেপ্তারের পরে জেলখানায় থাকা অবস্থাতেই তাকে ২০২৩ সালের নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখাচ্ছে এই ফ্যাসিস্ট সরকার। যা নজিরবিহীন ঘটনা। সকল মামলায় জামিন থাকার পরেও জামায়াত নেতৃবৃন্দকে মুক্তি না দিয়ে একটির পর একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারান্তরীণ রাখা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা পুলিশ কর্তৃক বিরোধীদলীয় নেতাদের ক্ষেত্রে ডাণ্ডাবেড়ির ব্যবহার দেখছি। এটি বাংলাদেশের পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেআইনি আটক দীর্ঘায়িত করার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পুলিশ হেফাজতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, মানসিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হন। আসন্ন নির্বাচনে বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদদের অংশগ্রহণে বাধা দিতে তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হয়রানিমূলক কার্যক্রম চালানো হবে তা সহজেই অনুমেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর নকীব মুহাম্মদ নাসরুল্লাহ বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বিশ্ব পরিসংখ্যানে যদি আমরা দেখি তবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনে আমরা সবচেয়ে পিছনে রয়েছি। বাংলাদেশে কোনো মানবাধিকার নেই, বাক-স্বাধীনতা নেই। নির্বাচন কমিশন দু’টি দলকে নিবন্ধন দিয়েছে যাদের কোনো অফিস আছে কিনা সন্দেহ। অথচ রাজপথে আন্দোলন করা গণমুখী দলগুলোকে নিবন্ধন দেয়া হয়নি। দেশে গণতন্ত্র নাই বলেই হিরো আলমরা প্রতিবাদ করে। সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন প্রফেসর আব্দুল হান্নান বলেন, দেশে আইনের শাসন নাই। মানুষ বিচার পাচ্ছে না। সাধারণ নাগরিকদেরকে যখন তখন পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। থানায় জিডি করতে গেলে জিডি নেয়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির খোঁজ পাই না পরিবার। বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী হলেই রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়।