ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার আশায় বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আগামী ডিসেম্বরের শেষ দিকে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। আইএমএফের সফররত প্রতিনিধদলের কাছ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা এমন ইঙ্গিত পেয়েছেন এবং সেটাই তাঁদের আশাবাদের ভিত্তি বলে জানান।

আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি ৪ অক্টোবর থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার তারা অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে, যাদের সঙ্গে আজ বৃহস্পতিবারও আলোচনা করবে।

এ ছাড়া আজ দুপুরে ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে আইএমএফ দলের মধ্যাহ্নভোজ রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক আজ বেলা দুইটায় আইএমএফ দলের বর্তমান সফরের সার্বিক দিক নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করবে বলে জানিয়েছে।

আইএমএফ এ বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের তিন দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় হয়। তবে আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের সব কিস্তির পরিমাণই হবে ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলার করে। এবার প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফর নিয়ে যে প্রতিবেদন দেবে, সেটিই সংস্থাটির আগামী ডিসেম্বরে পর্ষদ বৈঠকে বিবেচিত হবে। ওই বৈঠকে অনুমোদিত হলেই মিলবে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ।

সরকারি সূত্রগুলো জানায়, সময়ভিত্তিক রিজার্ভ না থাকা, একক মুদ্রা বিনিময় হার চালু না হওয়া এবং রাজস্ব আয় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা—মোটাদাগে এ তিন কারণে আইএমএফের দল বাংলাদেশের ওপর নাখোশ। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো আইএমএফের সফররত দলকে দেশের বাস্তবতা বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে যে এ তিন বিষয়ের লক্ষ্যমাত্রা আরেকটু শিথিল হওয়া দরকার। নইলে শর্তগুলো পালন করা কঠিন হয়ে পড়বে। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে শর্তগুলো পালন করা যাবে না। তবে নির্বাচনের পর সরকার এ ব্যাপারে মনোযোগী হবে। আইএমএফের দলও বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝেছে এবং তিন বিষয়ে শর্ত শিথিল কররা
ইঙ্গিত দিয়েছে।

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, গত জুনে বাংলাদেশের প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ থাকার কথা ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। কিন্তু তা রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ রাখার লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার। সেটিও হয়নি। ডিসেম্বরের লক্ষ্য ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ তা–ও পারবে না বলে ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে।

সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকৃত রিজার্ভ নতুন করে ২ হাজার কোটি ডলারে বেঁধে দিতে পারে আইএমএফ, যা বর্তমানে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের কম। ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল ২ হাজার ৬৮১ কোটি ডলার। সে হিসাবে আগামী জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা কমতে পারে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি।

আইএমএফ কেন নমনীয় হচ্ছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তাদের জানিয়েছি, আমদানি ব্যয় মেটাতে নিরুপায় হয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ কখনোই ব্যর্থ হয়নি। এ সুনাম ধরে রাখতে এত সংকটের মধ্যেও কিস্তি পরিশোধ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির একটি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। নতুন করে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) কমেছে। রপ্তানি আয়ও আশাব্যঞ্জক নয়।’

আইএমএফকে আরও জানানো হয়েছে, তারা চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া ৪ লাখ ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার কোটি টাকা না কমালে শর্ত পূরণ করা সম্ভব হবে না।

আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার একক বিনিময় হার রাখার শর্ত দিয়েছিল। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ঠিক একক না হয়ে একটা সীমার মধ্যে হলে তা ভালো হয়, যা পরে পরিপূর্ণভাবে বাজারভিত্তিক হয়ে যাবে। আইএমএফের দল এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।

বাংলাদেশ দ্বিতীয় কিস্তি পাবে বলে আশা করলেও তা এখনো নিশ্চিত নয়। কারণ, শর্ত পূরণ না হওয়ায় চলতি মাসেই শ্রীলঙ্কার ঋণের কিস্তি আটকে দিয়েছে আইএমএফ।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী কারণে কোন শর্ত পালন করতে পারেনি, এমন বিবরণ দিয়ে আইএমএফের দলকে যদি সরকার কোনো অনুরোধসংবলিত চিঠি দিয়ে থাকে এবং এ দল যদি তা নেয়, তাহলে বুঝতে হবে যে দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ইতিবাচক। আর আইএমএফের দল যদি চিঠি না নিয়ে বলে যে আমরা আগে পর্ষদে গিয়ে আলোচনা করব, তাহলে ধরে নিতে হবে যে সমস্যা আছে। কোনটা হতে যাচ্ছে আমরা তো এখন জানি না।’

প্রথম আলো