- রিন্টু আনোয়ার: ১২ আগস্ট ২০২৩
মগের না হোক, একটা আচ্ছা রকমের মুল্লুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দেশের নাগরিকদের। জারির পর থেকে সরকারের দাবি ছিল- জাতির প্রয়োজনে, জনস্বার্থেই করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
আরোপের আগ থেকেই এটি নিয়ে মানুষের আপত্তি। প্রণয়নের পর এ আইনে অবিরাম হয়রানির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এটি বাতিলের দাবি ওঠে। কেউ কেউ দাবি তোলেন সংশোধনের। কিন্তু, সরকারের দিক থেকে ড্যামকেয়ার ভাব। জনস্বার্থে প্রণীত আইন বাতিল দূরে থাক, সংশোধনেরও প্রশ্নই আসে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়। এখন আইনটি পরিবর্তন করে বলা হচ্ছে, তা জনস্বার্থেই করা হয়েছে। এতে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে। কী মশকরা জনস্বার্থ আর জনমত শব্দের সঙ্গে! আইন জারিও জনস্বার্থে। আবার পরিবর্তনও জনস্বার্থে।
জনস্বার্থ দেখতে দেখতে কাহিল সরকার। ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বদলের নীতিগত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে কী বার্তা পেল মানুষ? প্রথমত, আইনটি সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমসহ দেশের মানুষ এতদিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিল, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণ পেয়েছে। দ্বিতীয়ত. বহির্বিশ্বের চাপের ফল আর তৃতীয়ত সবার সঙ্গে চাতুরী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে আইন করার ঘোষণা চাতুরীতে ভরপুর। কিছু বিধি এদিক সেদিক নিয়ে সরকার ডিজিটালকেই সাইবার করতে যাচ্ছে। এর পরও শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় সেটা দেখার অপেক্ষা। সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের উদ্বেগ আমলে নেয়নি। নির্বাচনের আগে একটি আবহ তৈরির উদ্দেশ্যে সেই আইন সংশোধন বা পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও তাঁদের মতামত নেওয়া যেত। সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু সেরকম কিছু না করে বলা হচ্ছে, জনস্বার্থেই এখন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কী হাল জনস্বার্থের!
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাস্তি কমানোর মতো বিষয়টি নতুন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এটি আসলে খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়। বরং যেসব ধারা নিয়ে বিতর্ক ছিল সেগুলো এখনো বহালতবিয়তেই রয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের যে জায়গাগুলো নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল সে জায়গাগুলো সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রয়ে গেছে। এর ফলে এটি অপপ্রয়োগেরও সুযোগ রয়েছে এবং এটি দিয়ে নিবর্তনমূলক কার্যক্রম করারও সুযোগ রয়ে গেছে। এই আইনের আওতায় জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি নামে নতুন একটি সংস্থা হবে যাদের কাজ হবে সাইবারসংক্রান্ত অপরাধগুলোকে চিহ্নিত করা এবং এই অপরাধগুলোর জন্য শাস্তির মাত্রা ঠিক করা। আগের আইনের কাঠামোয় অ-জামিনযোগ্য ধারা থাকলেও সেগুলো নতুন আইনে বেশির ভাগই জামিনযোগ্য করা হয়েছে। তবে ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ ধারা এখনো অ-জামিনযোগ্য রয়েছে। এসব ধারার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কাঠামোতে বেআইনি প্রবেশ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা, সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংগঠন, আইনানুগ কর্তৃত্ব- বহির্ভূত ই-ট্রানজেকশন, বে-আইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ ও স্থানান্তর ইত্যাদি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল আপত্তির জায়গাগুলোতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দুয়েক ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ কমানো হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ শাস্তির বিধান রদ করা হয়েছে। তবে এতে, এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার ব্যক্তিদের আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো বিষয় নেই। যাদের আগে সাত বছর জেল হতো এখন তার তিন বছর জেল হবে, এটা মনে করে কি বেশি পুলকিত হওয়ার জায়গা আছে?
এই আইনে ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট করা বা অনুভূতিতে আঘাতের মতো বিষয়গুলো ফৌজদারি আইনে অপরাধ হিসেবে অন্যান্য দেশে প্রায় শত বছর আগে উঠে গেলেও সেগুলো এখনো বাংলাদেশে চর্চিত হচ্ছে। ফৌজদারি আইনের আওতায় অপরাধ হচ্ছে যেসব ক্ষতি দেখতে, জানতে ও বুঝতে পারা যায় সেগুলো। আর যেসব অপরাধের ক্ষতি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয় সেগুলো ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় থাকা উচিত নয়। যেমন- ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ’ করা, ‘অবমাননা’ বা ‘মানহানি’ ইত্যাদি। ‘অবমাননা’ আর ‘মানহানি’র মতো বিষয় নিয়ে দেওয়ানি আইনে মামলা হওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেওয়ানি ক্ষতির ব্যাপারগুলো আমরা ফৌজদারি আইনে নিয়ে এসে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করছি। মূল আপত্তি হলো ওই জায়গায়। ওই জায়গাগুলোতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। মানহানির মামলা ফৌজদারি আইনে করা হলে তাতে যে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে তা ওই ব্যক্তি পাবে না, বরং সেটা পাবে রাষ্ট্র। আর এই একই মামলা দেওয়ানি আইনে করা হলে ক্ষতিপূরণ পাবে ব্যক্তি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রতিস্থাপন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করার মানে এই নয় যে, এটা নিবর্তনমূলক হবে না, কারণ পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের মতো বিষয়টি এই আইনেও রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে এই ধারাটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে- পুলিশ কেন, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ক্ষমতা বুজর্গরাও হাতছাড়া না করে পারেন না। মানহানির ক্ষেত্রে ডিএসএ এর ২৯ ধারায় যে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ছিল সেটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর পরিবর্তে জরিমানার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থদণ্ডের এ পরিমাণ টাকা দেশের কতজন মানুষের আছে? বিশেষ করে সাংবাদিকদের ক’জন এ সক্ষমতা রাখেন? সেই সামর্থ্য না থাকা মানে কারাবাস। ফলে আইনটি সবার ক্ষেত্রে সমপ্রয়োগের সুযোগ কম। এ ধরনের আইনের পরিবর্তন আনার আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে আলোচনার গরজ মনে করেনি সরকার। অন্তত যারা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ভুক্তভোগী ছিলেন, যেসব পেশাজীবী এই আইনের শিকার হয়েছেন তাদের সাথে কথা বলা যেত। আগামী সেপ্টেম্বরে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি রহিত হয়ে যাবে বলে জানানো হয়। সরকারের দিক থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, আইন রহিত করা মানে সেই আইনটি বাতিল করা নয় বরং হেফাজত করা হয়। হেফাজত করার মানে হচ্ছে, পুরনো আইনের অধীনে যে মামলাগুলো শুরু হয়েছে সেই মামলাগুলোর জন্য পুরনো আইন বহাল থাকবে। অর্থাৎ ওই মামলাগুলোর জন্য ওই আইন এখনো জীবিত আছে, সেগুলোর বিচার ওই আইন অনুযায়ীই হবে। ফলে, বায়ান্ন-তেপ্পান্ন বা লাউ-কদু বুঝতে বাকি থাকে কিছু?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]