মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এক সভায় অকপটে মন্তব্য করেছেন, আমাদের মধ্যে যাঁরা ডাক্তার হন, তাঁরা হয় পুলিশের চাকরিতে চলে যান অথবা রাজনীতিবিদ হয়ে যান। তাঁরা ডাক্তারিও করেন না, গবেষণাও করেন না। তাঁর মতে, বিজ্ঞান ও কৃষিতে কিছু গবেষণা হচ্ছে, কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে তা নেই বললেই চলে।
তিনি আরও যুক্ত করেন, আরেক শ্রেণির ডাক্তার শুধু টাকা কামাই করতে ব্যস্ত, তাঁরা সরকারি চাকরিও করবেন, আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করবেন। প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্যের তিনটি দিক ভেসে উঠেছে। সেগুলো হলো, স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার আকাল, সরকারি চাকরিতে পেশাদারির নৈরাজ্য এবং সমাজ মনস্তত্ত্বে ক্ষমতা খাটিয়ে দ্রুত পয়সা করার বাতিক ও সুযোগের উপস্থিতি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসুলভ স্বাচ্ছন্দ্য থেকে এই উক্তি করলেও এখানে সমাজ মনস্তত্ত্বে যে দ্রুত ধনী হওয়ার দর্শন আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের কৈশোর শিক্ষার মধ্যেও আমরা তা সযতনে লালন করে যাচ্ছি। ছোটবেলায় ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা পড়ে মনে হয়েছে ইহজগতে ডাক্তার হওয়া ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য থাকা সম্ভব নয়। মানবসেবার জন্য ওটাই একমাত্র পথ। মাদার তেরেসার সেবালয়, পথকলিদের ইশকুল কিংবা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মডেল কোনো সমাজসেবা নয়। আমি লিখেছিলাম, ‘কবি হব।’ স্যার নম্বর ভালো দিলেও উৎকণ্ঠিত হয়ে ডেকে বললেন, ‘কবি হলে খাবে কী করে?’ স্যারও বিশ্বাস করতেন শিক্ষা মানে আলো। কিন্তু আলোর পাশাপাশি যে আলু কেনার পয়সাও থাকতে হবে, সেটা সতর্ক করে দিতেই স্যার তাঁর শিষ্যকে কাছে ডেকেছিলেন।
ডাক্তার হওয়ার পেছনে সেবাদানের মহান বাণীর চেয়ে পাহাড়তুল্য সম্পদ সঞ্চয়নের বাসনা যে কোনো অংশে কম নয়, তা ঠাহর করলাম বিদেশে এসে। এখানে ডাক্তার আর আইনজীবী হতে পারলে ইহকাল তো রমরমাই, এমনকি পরকালের জন্যও ফ্ল্যাট কিনে রাখা যায়। ছেলে বা মেয়ে ডাক্তারিতে চান্স পেলে বাঙালির আড্ডায় সংবাদ শিরোনাম হয়ে যায়। সামান্য ভালো ফলাফল করার পরও আমার ছেলেমেয়েকে কেন ডাক্তারি পড়ালাম না, এই দুশ্চিন্তায় কয়েক ঘর বাঙালি চার রাত ঘুমাতে পারেনি। অবশেষে আমাকে ‘বুদ্ধিনাশা’ ভেবে ওরা মনে সান্ত্বনা নিয়েছে এবং আমার সঙ্গে কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে ডাক্তারদের আয়–উপার্জন বিদেশের মতো না হলেও মোটামুটি বেশ ভালো। এর কারণ উচ্চ চাহিদার বিপরীতে ডাক্তারের সংখ্যাস্বল্পতা এবং বাংলাদেশিদের আয় বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে এক লাখ মানুষের জন্য ডাক্তারের সংখ্যা ১১২, ভারতে ৯৩ আর বাংলাদেশে তা মাত্র ৬৪। দারিদ্র্য কমলে ডাক্তারের আয় বাড়ে। ১৯৯১ সালে এ দেশের দারিদ্র্য ছিল ৫৭ শতাংশ।
যে সমাজে ধনিক বৃদ্ধির হার খোদ যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দেয়, যে সমাজে খেলাপি বা টাকা পাচারকারীদের বিচার হয় না, বরং ওনারা নির্বাচনে মনোনয়ন পান ও আইন বানান, সে সমাজে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের পুলিশ হওয়ার ইঁদুরদৌড় খুব একটা বেমানান নয়। শুদ্ধিটা সেখান থেকে শুরু না করলে একদিন অধ্যাপক ও গবেষকেরাও দারোগা হতে চাইবেন। শিকেয় উঠবে তাবৎ গবেষণা।
এখন তা ২৪ শতাংশ অর্থাৎ সে সময় থেকে দারিদ্র্য কমেছে শতকরা ৫৮ ভাগ। ১৯৯১ সালের মাথাপিছু আয় ২৮৩ ডলার থেকে বেড়ে এখন হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ডলার অর্থাৎ এটি প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। কিন্তু একই সময়ে ডাক্তারের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ। একদিকে চাহিদা বৃদ্ধি, অন্যদিকে জোগান ঘাটতির দ্বিমুখী টানে চিকিৎসকের দাম ও উপার্জন আকাশচুম্বী। গত তিন বছরে আট লক্ষাধিক বাংলাদেশি ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে গেছেন। এখন বছরে তিন লাখ মানুষ ভারতে ডাক্তার দেখাতে যান, এর একটা বড় কারণ, বাংলাদেশে ভালো ডাক্তারেরা অধিক ব্যয়বহুল।
এত ভালো প্রাপ্তিযোগের পরও ডাক্তার কেন পুলিশ হন। এর প্রথম কারণ, সরকার ডাক্তারকে পুলিশ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। কলাভবনে পড়া একজন স্নাতক বানাতে সরকারের যা খরচ হয়, তার চেয়ে আট-দশ গুণ বেশি খরচ বহন করে আমাদের রাষ্ট্র একজন ডাক্তার বা প্রকৌশলী বানায়।
পুলিশের যে চাকরি করতে পারে একজন সাধারণ স্নাতক, সে চাকরিতে একজন ডাক্তার বা প্রকৌশলীকে ঢুকতে দেওয়ার সুযোগ থাকাটাই একটা অন্যায়। এটা যে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়, এটা অনুধাবন করে সরকারকে চাকরির বিধিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসিকে এই মর্মে নির্দেশ দিতে পারেন।
পিএসসি ইতিমধ্যে ভাইভা পরীক্ষার ন্যায়ভিত্তিক সংস্কার করেছে। কারণ, বিসিএসের ভাইভায় যে স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, বৈষম্যকরণ ও দুর্নীতির পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে, এটা বুঝতে আমাদের ৫০ বছর সময় লেগে গেল। নতুন ভাইভা পদ্ধতিতে এগুলো কমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে প্রার্থীর নামধাম, ধর্ম-বর্ণ জিজ্ঞেস করার সুযোগ নেই। ঠিক এ রকম একটি সংস্কার প্রার্থীর প্রাথমিক বাছাইয়েই নিয়ে আসা উচিত, যাতে ডাক্তার বা প্রকৌশলীরা ঠিক তাদের নির্দিষ্ট চাকরিগুলোতেই আবেদন করতে পারবেন।
বাংলাদেশে পুলিশের সংখ্যায় কি এতই আকাল? মোটেই নয়। প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার জন্য এ দেশে পুলিশের সংখ্যা ১৫৫। ভারতে এটি ১৫২। পাকিস্তানের কথা আলাদা। ওদের দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও জঙ্গি বোমার মহোৎসব লেগেই আছে। তবু ওদের সংখ্যা লাখে ১৮২। বাংলাদেশে পুলিশের সংখ্যা এ দেশের ডাক্তারের সংখ্যার চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ। তারপরও ডাক্তারকে পুলিশ হতে হয় কেন। এর উত্তর প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, টাকা কামাইয়ের ব্যাকুলতা। কিন্তু সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী একজন ডাক্তারের আয় একজন পুলিশের আয়ের চেয়ে কম হওয়ার কথা নয়।
তারপরও ডাক্তার পুলিশ হতে চান। কারণ, জ্ঞানের ক্ষমতার চেয়ে ডান্ডার ক্ষমতা খাটিয়ে এই সমাজে রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায়। ডাক্তারের উন্নতি গাণিতিক হারে, কিন্তু পুলিশের উন্নতি জ্যামিতিক হারে, কারণ এই অন্যায়প্রবণ সমাজে চাপে ফেলে টাকা আদায়ের কৌশল ও পর্যাপ্ত সুযোগ পুলিশের আছে। শিল্পী নচিকেতার গান ‘ও ডাক্তার’ শুনলে বোঝা যায়, সে রকম সুযোগ ডাক্তারদেরও কম নেই। শিশুজন্মে এ দেশে যে ‘সিজারিয়ান’-এর বিপ্লব হয়ে গেছে, সে কথা খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বীকার করে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সিজারিয়ান জন্মের হার শতকরা ১০ থেকে ১৫-এর মধ্যে রাখার সুপারিশ রয়েছে। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে এটি ৩৩ শতাংশ, যা ২০০৪ সালে ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। হঠাৎ এই আট গুণ বৃদ্ধির মূল কারণ বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বেসরকারি ক্লিনিকে এই হার ৮৩ শতাংশ।
কারণ, ‘নরমাল ডেলিভারি’-এর চেয়ে সিজারিয়ান হলে আয় ১০ গুণ বাড়ে। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ দেখিয়েছিল যে শুধু ২০১৬ সালে সোয়া আট লাখ সিজারিয়ান জন্মের মধ্যে পৌনে ৬ লাখই ছিল অপ্রয়োজনীয়। একেই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন টাকা কামাইয়ের ব্যস্ততা। তাই সরকারি চাকরির পরও প্রাইভেট প্র্যাকটিস চাই।
তারপর পুলিশের মতো দমে দমে খাওয়ার সুবিধা ডাক্তারদের নেই বলেই ডাক্তার পুলিশ হন। প্রকৌশলী পাসপোর্ট বিভাগের পুলিশ তদন্ত দেখেন। কারণ, ওখানে দুর্বলকে একটু চিপায় ফেলে ‘কৌশলী’ হতে পারলেই দ্রুত আয় বাড়ে। বিল্ডিংয়ের নির্মাণে এত পয়সা নেই।
যে সমাজে ধনিক বৃদ্ধির হার খোদ যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দেয়, যে সমাজে খেলাপি বা টাকা পাচারকারীদের বিচার হয় না, বরং ওনারা নির্বাচনে মনোনয়ন পান ও আইন বানান, সে সমাজে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের পুলিশ হওয়ার ইঁদুরদৌড় খুব একটা বেমানান নয়। শুদ্ধিটা সেখান থেকে শুরু না করলে একদিন অধ্যাপক ও গবেষকেরাও দারোগা হতে চাইবেন। শিকেয় উঠবে তাবৎ গবেষণা।
- ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ড-এ অর্থনীতির অধ্যাপক