দেশে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে ডলার সংকট চলছে। এ সময়ে সংকট না কমে উল্টো প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় ডলার ক্রাইসিস আরও প্রকট হয়েছে। ডলার সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসছে না। সম্প্রতি নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা নিশ্চিত করতে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সঙ্গে যোগ দেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। বিশেষ অভিযানে বেশি দামে ডলার বিক্রির অপরাধে বেশকিছু মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স স্থগিত ও সিলগালা করা হয়। এতে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পরিচিত ছাড়া কারও কাছে ডলার বিক্রি করছেন না। এতে খোলাবাজারেও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে।
বিদেশগামীদের নগদ ডলারের প্রধান উৎস এই খোলাবাজার। এখন এসব মানুষ খোলাবাজারে এসে নগদ ডলার পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ী, বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসাপ্রার্থী সবাই ডলারের জন্য হাহাকার করছেন। কোথাও পাওয়া গেলেও নগদ এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৭ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। বাধ্য হয়ে চড়া দামে ডলার কিনতে হচ্ছে বিদেশগামীদের। এ অবস্থায় চলমান ডলার সংকট কবে কাটবে, কেউই তা বলতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ডলারের মজুতও কমে আসছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বার্তা দিয়েছে, যেকোনো নিয়ম ভঙ্গের দায়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। ফলে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা এখন শাস্তির মুখে। একই সঙ্গে শীর্ষ ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, আর্থিক খাতে সংকট আরও বেড়ে যেতে পারে- এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না।
যেসব পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, তার একটি ডলারের ভবিষ্যৎ দাম (ফরওয়ার্ড রেট) নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালু। এজন্য বেঁধে দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ হারও। নতুন নিয়মে এক বছর পর ব্যাংক ডলারের দাম হিসেবে বর্তমান স্মার্ট হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত নিতে পারবে। এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই নিয়ম চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অন্যদিকে গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় দেশে এসেছে গত মাসে। সেপ্টেম্বরে বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের এপ্রিলে এত কম প্রবাসী আয় দেশে এসেছিল। ওই মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ১০৯ কোটি ডলার। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় ডলার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এ অবস্থায় ডলার সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কিছু ব্যাংককে ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনার পরামর্শ দিয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি। যার প্রভাব পড়ছে সবকিছুর ওপর। আবার গেল দুই মাস ধরে ভাটা পড়েছে প্রবাসী আয়ে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক পদেক্ষপ নিলেও তা খুব বেশি কাজে আসছে না। বরং ডলার পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠছে।
এদিকে ডলার সংকটের কারণে বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব বেসরকারি খাতে বেশ কঠিনভাবেই পড়তে শুরু করেছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। ডলার সংকটে আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। রপ্তানির আদেশ কমায় এ শিল্পের কাঁচামালের আমদানি ও এলসি দুটোই হ্রাস পেয়েছে। নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে। এখন ঋণে সুদের হার বাড়তে শুরু করেছে। আমদানি পণ্য, ডলার ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় ক্রয়ক্ষমতা কমায় বিক্রিও কমে গেছে। ফলে শিল্প খাতের উৎপাদনও আগের মতো নেই। এসব মিলে সার্বিকভাবে বেসরকারি খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কেননা কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে। এ খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে পুরো অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলার সংকটে দাম বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় উদ্যোক্তারা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। তারা বিনিয়োগ করছেন না। বিনিয়োগ করলেই ডলারের প্রয়োজন। কিন্তু ব্যাংকে ডলার মিলছে না। এ অবস্থা আরও চলতে থাকলে বেসরকারি খাত বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে প্রবাসী আয় আরও কমতে পারে। এতে ডলার সংকটের কারণে অনেক আমদানি বাতিল হতে পারে। এতে প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।
প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি বিল বেশি হওয়ায় কমে গেছে দেশের রিজার্ভ। তাই গত দেড় বছর ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলছে। দেশের বাজারে ডলারের এক্সচেঞ্জ দর নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবশেষ ২৫শে সেপ্টেম্বর ডলারের দর ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। নতুন হার অনুযায়ী, রপ্তানিকারক ও রেমিট্যান্স পাঠানো ব্যক্তিরা প্রতি ডলারে ১১০ টাকা পাবেন। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের কাছ থেকে ডলারপ্রতি ১১০ টাকা ৫০ পয়সা নেবে।
রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকার একচেঞ্জ হাউজ ঘুরে দেখা গেছে, অলস সময় পার করছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা। বেচাকেনার দাম লেখা আছে বোর্ডে, কিন্তু ডলার নেই। বিক্রেতারা বলছেন, নির্ধারিত দামে তারা কিনতে পারছেন না, তাই বিক্রিও বন্ধ। তবে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যদিয়ে কোথাও পাওয়া গেলেও নগদ ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা।
রাজধানীর পল্টন এলাকায় একাধিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ঘুরেও ডলার পাননি জরুরি প্রয়োজনে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক কল্লোল। তিনি বলেন, কোথাও একশ’ ডলার পেলাম না। শেষে অনুরোধ করলাম ডলার না দিলেও পাসপোর্ট এনডোর্স করে দিতে, তাও করলো না। ডলার ছাড়া পাসপোর্ট এনডোর্স করবে না।
একটি মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বলেন, এসোসিয়েশনের ঠিক করে দেয়া দরে ডলার কেনাও যাচ্ছে না। তাহলে বিক্রি করবো কীভাবে? বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে ফোনে যোগাযোগ করলে কেনা যাচ্ছে, যেগুলোর দাম পড়ছে বেশি।
ডলার সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে দর নির্ধারণকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, প্রবাসীরা ভিন্ন পন্থায় ৪-৫ টাকা রেট বেশি পাওয়ার কারণে তারা সেদিকেই ঝুঁকছেন বেশি। এতে রেমিট্যান্স হারাচ্ছে দেশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমানে ডলারের যে সংকট চলছে, সেটা থেকে উত্তরণের জন্য নানা রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোনোটাই কাজে দেয়নি। উত্তরণের ক্ষেত্রে যেটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক্সচেঞ্জ রেটটা বেঁধে দেয়া। যেখানে বাজারদর হচ্ছে ১১৭-১১৮ টাকা, সেখানে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দিয়ে কেউ বিক্রি করতে চাইবে না। যাদের অপশন আছে ইনফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রি করলে ৪-৫ টাকা বেশি পাওয়া যাবে, তারা তো সে দিকেই যাবে। তিনি বলেন, হুকুম দিয়ে বাজারদর নির্ধারণ করা- এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে সংকট আরও বাড়বে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কিছু মধ্যমেয়াদি কাজ করতে হবে। রপ্তানি আরও বাড়ানো যায় কীভাবে সেটা চেষ্টা করা। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। আমদানির ক্ষেত্রে দেখতে হবে, কিছু আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিনা। তবে বড় কথা হচ্ছে, ডলারের রেট ফিক্সড করে দেয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম এখনো বাজারভিত্তিক হচ্ছে না। ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তা বাজারভিত্তিক করতে হবে। যে ধরনের সংস্কার কার্যক্রম নেয়া প্রয়োজন, তা-ও নেয়া হচ্ছে না। ফলে উদ্যোগগুলোর সুফল মিলছে না। এখন সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে, বাজেট ভর্তুকি ও সরকারি খরচ কমিয়ে সংকটের সমাধান করতে হবে। অর্থ পাচার কমাতে শাস্তি দিতে হবে। এসব না করলে সংকট থেকে বের হতে আরও দীর্ঘ সময় লাগবে।