ডলার–সংকটের কারণে আটকে গেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক তিন কোম্পানির ২২০ কোটি টাকার লভ্যাংশ বিতরণ। এক বছরের বেশি সময় ধরে চেষ্টা করেও আটকে থাকা এ লভ্যাংশ বিদেশি মালিকদের কাছে পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশে কার্যক্রম চালানো কোম্পানি তিনটি।
এই তিন কোম্পানির বাইরে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আরও দুটি কোম্পানির ৮১৬ কোটি টাকা দীর্ঘ সময় আটকে থাকার পর সম্প্রতি এই অর্থ তারা তাদের বিদেশি মালিকদের কাছে পাঠাতে পেরেছে।
তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি এবং আকাশপথে পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বিদেশি বিমান সংস্থার বড় অঙ্কের মুনাফার প্রত্যাবাসনও বেশ দীর্ঘ সময় ধরে আটকে আছে। আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা বা আইএটিএর গত জুনে প্রকাশ করা সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিদেশি বিভিন্ন বিমান সংস্থার ২১ কোটি ৪১ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা বাংলাদেশে আটকে আছে। এর বড় অংশই বিমানের টিকিট বিক্রি বাবদ পাওয়া অর্থ, যা তারা বিদেশের মূল কোম্পানিতে ফেরত নিতে পারছে না।
জানা গেছে, শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত নয় এমন একটি শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক কোম্পানির বড় অঙ্কের মুনাফাও কয়েক বছর ধরে আটকে আছে। প্রতিষ্ঠানটি এ মুনাফার অর্থ বিদেশে পাঠাতে কয়েক দফায় ডলার জোগাড়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে বিদেশি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে আপাতত মুনাফার অর্থ দেশে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানিটির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন এটিকে অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি। কারণ, আমরা বুঝতে পারছি ডলার–সংকট পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হবে না।’
তালিকাভুক্ত কোম্পানির দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে লভ্যাংশের অর্থ বিতরণে কোনো অসুবিধা না হলেও সমস্যা দেখা দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে।
নিয়ম অনুযায়ী, আর্থিক বছর শেষে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো যে লভ্যাংশ ঘোষণা করে, তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারধারীদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়। ঘোষিত এই লভ্যাংশ কোম্পানিটির বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএমে অনুমোদনের ৩০ দিনের মধ্যে বিতরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। শেয়ারধারীদের প্রাপ্য এ অর্থ কোম্পানির পক্ষ থেকে আলাদা একটি ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের নিজ নিজ হিসাবে সেই অর্থ স্থানান্তরিত করে।
কিন্তু বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানি তাদের মালিকানায় থাকা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে লভ্যাংশ পাঠাতে পারেনি দীর্ঘ সময় ধরে চলা ডলার– সংকটের কারণে। ব্যাংকগুলো ডলার সরবরাহ করতে না পারায় লভ্যাংশের এ অর্থ এখন দেশেই আটকে আছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে মুনাফার টাকা এভাবে আটকে থাকলে তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এ দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দেয়। ফলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিদেশি পোর্টফোলিও (পত্রকোষ) বিনিয়োগকেও তা প্রভাবিত করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন মুনাফা আটকে থাকলে এর প্রকৃত সুবিধাভোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ, এ সময়ে টাকা অবমূল্যায়িত হলে তাদের মুনাফার পরিমাণ কমে যায়।
বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি বা ফরেন চেম্বার) সাবেক সভাপতি রূপালী হক চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, আগের চেয়ে এখন পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ধাপে ধাপে লভ্যাংশ পাঠানোর সুযোগ পাচ্ছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। ডলার না পাওয়ার কারণে কিছুটা সমস্যা হওয়ায় অনেকে অন্য মুদ্রায় লভ্যাংশ বিদেশে মালিকদের কাছে পাঠাচ্ছে। তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে বহুজাতিক তিনটি কোম্পানির মোট ২২০ কোটি টাকার লভ্যাংশ দেশেই আটকে আছে। এই কোম্পানি তিনটি হলো বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, ম্যারিকো বাংলাদেশ এবং রেকিট বেনকাইজার বাংলাদেশ। এর মধ্যে বার্জারের সর্বোচ্চ ১৩৬ কোটি ৪০ লাখ, ম্যারিকোর ৪৫ কোটি ৩৩ লাখ এবং রেকিট বেনকাইজারের ৩৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা আটকে আছে।
জানতে চাইলে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের কোম্পানি সচিব খন্দকার আবু জাফর সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ২০২২ সাল থেকে দেশে ডলার–সংকট শুরু হওয়ার পর বিদেশি মালিকদের লভ্যাংশ পাঠানো ক্ষেত্রে আমরা সমস্যায় পড়েছি। এ কারণে বেশ কিছু লভ্যাংশ আটকে আছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জসহ (ডিএসই) একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে কোম্পানিগুলো তাদের লভ্যাংশ বিতরণ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেসব প্রতিবেদনের পাশাপাশি কোম্পানিগুলো সর্বশেষ আর্থিক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এসব বণ্টন না হওয়া লভ্যাংশকে অপ্রদেয় বা আনপেঅ্যাবল হিসাবে দেখানো হয়েছে। একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এর বাইরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত টেলিকম খাতের বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোন এবং রবি আজিয়াটার প্রায় ৮১৬ কোটি টাকার লভ্যাংশ ডলার–সংকটের কারণে দীর্ঘদিন দেশে আটকে ছিল। এর মধ্যে ছিল গ্রামীণফোনের ৫৩৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ও রবি আজিয়াটার ২৮০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। সম্প্রতি এ দুটি কোম্পানি লভ্যাংশের এ অর্থ বিদেশে মালিক প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠিয়েছে বলে কোম্পানি দুটি জানিয়েছে।
তবে সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষে কোম্পানি দুটি যে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এ অর্থ অপ্রদেয় লভ্যাংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল।
গ্রামীণফোনের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান শারফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২২ সালের জন্য আমরা যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিলাম, তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা–সংকটের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশটি পাঠাতে দেরি হয়েছে। সম্প্রতি আমরা লভ্যাংশের এ অর্থ বিতরণ সম্পন্ন করেছি।’
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি ১১টি। এর মধ্যে পাঁচটি কোম্পানি গত বছর বিদেশি মালিকদের কাছে তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশের অর্থ পাঠাতে সমস্যায় পড়ে। বিদেশি মালিকানাধীন এসব প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ সাধারণত কোম্পানিগুলো ডলারে পাঠিয়ে থাকে।
গ্রামীণফোনের শেয়ারের ৫৫ দশমিক ৮০ শতাংশের মালিকানা রয়েছে নরওয়েভিত্তিক টেলিনর মোবাইল কমিউনিকেশনসের হাতে। রবি আজিয়াটার ৯০ শতাংশ শেয়ারের মালিক মালয়েশিয়াভিত্তিক আজিয়াটা ইনভেস্টমেন্টস (লাবুয়ান) লিমিটেড ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভারতী ইন্টারন্যাশনাল পিইটি লিমিটেড। বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে জে অ্যান্ড এন ইনভেস্টমেন্টসের (এশিয়া) হাতে। রেকিট বেনকাইজারের প্রায় ৮৩ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মূল কোম্পানি। এ ছাড়া ম্যারিকো বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে ভারতের ম্যারিকো লিমিটেডের হাতে।
কোম্পানিগুলোর মালিকানায় থাকা বিদেশি এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর কোম্পানির মুনাফার ভাগ পান লভ্যাংশ হিসেবে। যেহেতু কোম্পানিগুলোর মালিকানার বড় অংশই বিদেশিদের হাতে, তাই ঘোষিত লভ্যাংশের সিংহভাগই চলে যায় এই মালিকদের কাছে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ আটকে থাকা মানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশ সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা যাচ্ছে। তাতে ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগকারীর মধ্যে যাদের এ দেশে সরাসরি বিনিয়োগ বা পোর্টফোলিও বিনিয়োগে আগ্রহ আছে, তারা নিরুৎসাহিত হবেন।
Prothom Alo