ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এমনিতেই চরম ডলার সংকট রয়েছে। সংকট কাটাতে রপ্তানিতে উৎসাহ দেওয়ার পরামর্শ আসছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এতে রপ্তানি আরও কমতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডলার সংকট আরও তীব্র হতে পারে।
জানা গেছে, আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়া, বিদেশি ঋণ কমাসহ বিভিন্ন কারণে সরকার এখন আর্থিক সংকটে আছে। যে কারণে বিভিন্ন খাতের প্রণোদনা ও পাওনা যথাসময়ে দিতে পারছে না সরকার। শুধু সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বাবদ সরকারের কাছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনা রয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর পাওনা ২৫ হাজার কোটি টাকা দায়দেনার বিপরীতে বন্ড ইস্যু করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানি প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, বস্ত্র খাতের পাঁচটি এইচএস কোডের আওতায় রপ্তানি হওয়া পণ্যে কোনো নগদ সহায়তা দেওয়া হবে না। এইচএস কোডগুলো হলো– ৬১০৫, ৬১০৭, ৬১০৯, ৬১১০ এবং ৬২০৩। এই পাঁচটি কোডে বস্ত্র খাতের মোট ৫৬ শতাংশ রপ্তানি হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যেহেতু রপ্তানি আদেশ নেওয়ার সময় ভর্তুকিসহ হিসাব করে তারা পণ্যের দর নির্ধারণ করেন, ফলে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়া সরকার মাঝপথে এসে এভাবে হঠাৎ ভর্তুকি তুলে নেওয়া এবং কমানোয় তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, রপ্তানি বাণিজ্য উৎসাহিত করতে ৪৩টি পণ্য ও খাতে নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধান অনুসারে যা রপ্তানি ভর্তুকি হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর কোনো ধরনের নগদ সহায়তা দেওয়া যাবে না। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। উত্তরণের পর সম্পূর্ণ নগদ সহায়তা একবারে প্রত্যাহার করলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
যে কারণে বিভিন্ন খাতে নগদ সহায়তার হার অল্প অল্প করে কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত জাহাজীকরণ পণ্যে নতুন হার প্রযোজ্য হবে।
রপ্তানিমুখী দেশীয় বস্ত্র খাতে শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। আগে যা ৪ শতাংশ ছিল। ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানিকারকদের প্রণোদনার হার ৩ শতাংশের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তাও ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। নিট, ওভেন, সোয়েটারসহ তৈরি পোশাক খাতের সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অতিরিক্ত ৪ শতাংশই বহাল থাকবে। তবে নতুন পণ্য বা বাজারে ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৩ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে বিশেষ নগদ সহায়তা ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। আর এসব খাতে নির্ধারিত পাঁচটি এইচএস কোডের রপ্তানির বিপরীতে কোনো নগদ সহায়তা মিলবে না। ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়েছে। আর ফিনিশড লেদারে ভর্তুকি ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদ উল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, বস্ত্র খাতের কর্মীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দর বাড়ানোর কারণে কারখানাগুলো এমনিতেই সমস্যায় রয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ সংকটের কারণে অনেক কারখানায় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ঋণের সুদহার অনেক বেড়েছে। এ রকম সময়ে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বস্ত্র খাতের পাঁচটি এইচএস কোডের বিপরীতে প্রণোদনা পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। এসব এইচএস কোডের আওতায় মোট রপ্তানির ৫৬ শতাংশের মতো হয়ে থাকে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত না নিয়ে পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে জানালে ব্যবসায়ীরা সে আলোকে অর্ডার নিতেন। এতে করে রপ্তানিকারকরা নিরুৎসাহিত হবেন। রপ্তানি কমবে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমকালকে বলেন, গত জুলাইয়ে সুদহারের নতুন ব্যবস্থার ফলে ৩ শতাংশের মতো সুদ বেড়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ব্যবসায়ীদের অনেকে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করছেন। এখন নগদ সহায়তা তুলে নেওয়া এবং কমানোর কারণে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এর প্রভাবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে।
কোন পণ্যে কত কমলো
নতুন নিয়মে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যে নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, হালকা প্রকৌশল পণ্যে ১৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ পাটপণ্যে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ এবং পাটজাত চূড়ান্ত দ্রব্যে ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। পাটের সুতায় ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ওষুধের কাঁচামালে নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ থেকে কমে ১০ শতাংশ হয়েছে। শতভাগ হালাল মাংসে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে সব পর্যায়ে সহায়তা ১ শতাংশ কমানো হয়েছে। হিমায়িত চিংড়িতে বরফ আচ্ছাদনের হার ২০ শতাংশ পর্যন্ত হলে ৯ শতাংশ, ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে হলে ৮ শতাংশ এবং ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হলে ৭ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশের বেশি হলে ৬ শতাংশ নগদ সহায়তা পাবে। অন্যান্য মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রেও নগদ সহায়তার হার কমানো হয়েছে।
এতদিন ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা ছিল, এখন থেকে ৮ শতাংশ পাবে এমন পণ্যের তালিকায় রয়েছে– মোটরসাইকেল, রেজর ও রেজর ব্লেড, কনজুমার ইলেকট্রনিকস, পেট বোতল ফ্লেক্স, জাহাজ, প্লাস্টিক দ্রব্য, হাতে তৈরি পণ্য যেমন– হোগলা, খড়, আখ বা নারকেলের ছোবড়া, গার্মেন্টের ঝুট এবং গরু ও মহিষের নাড়িভুঁড়ি, শিং ও রগ, কাঁকড়া ও কুঁচে। পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বন ও জুট পার্টিকেল বোর্ড, শস্য ও শাকসবজির বীজ, আগর ও আতর রপ্তানিতে ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ, ফার্নিচারে ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ, অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি ১৫ থেকে ১২ শতাংশ, সিনথেটিক ও ফেব্রিক্সের মিশ্রণে তৈরি পাদুকা ও ব্যাগে ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ এবং দেশে উৎপাদিত কাগজ রপ্তানিতে ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
সফটওয়্যার, আইটিইএস ও হার্ডওয়্যারে ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং সফটওয়্যার ও আইটিইএস ব্যক্তি পর্যায়ের ফ্রিল্যান্সারদের সহায়তা ৪ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। বিশেষায়িত অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের ভর্তুকি কমিয়ে শূন্য ৫ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত চা, এমএস স্টিল পণ্যে ৪ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বাইসাইকেল ও এর পার্টস, সিমেন্ট রপ্তানিতে সাড়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। চাল রপ্তানিতে ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ, কেমিক্যাল পণ্যে ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ এবং টুপি রপ্তানিতে ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে।
সূত্র : সমকাল