দীর্ঘ দুই বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। এখনো চলমান। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে তীব্র গ্যাস সংকট সৃষ্টি হয়। যা এখন অনেকটা উন্নতি হয়েছে। সবমিলিয়ে একদিকে ডলার সংকটে সার আমদানিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ না পেয়ে উৎপাদনকারী কোম্পানি সার উৎপাদন করতে পারছে না। পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে কৃষকরা সময়মতো সার হাতে পাবে না। ফলে ডলার ও গ্যাস সংকটের ধাক্কা পড়েছে সারের ওপর। এতে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ডলার সংকটে বিসিআইসি’র সার আমদানির ঋণপত্র বা এলসি অনুমোদন করছে না অগ্রণী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক। বলছে, এলসি সংকটে সার আমদানি করা না গেলে বিপর্যয়ে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সূত্র সার আমদানির জন্য এলসি খুলতে না পারার বিষয়টি জানিয়েছে।
এদিকে গ্যাসের সরবরাহ না পেয়ে ইউরিয়া উৎপাদনকারী যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল) প্রায় এক মাস ধরে সার উৎপাদন করতে পারছে না। কারখানাটি কবে চালু হবে তার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এদিকে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) কোম্পানিকে রেশনিং করে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানিও এ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিসিআইসি’র কর্মকর্তারা বলেন, এখন তিনটি কারখানা উৎপাদনে আছে। গ্যাসের কারণে একটা বন্ধ।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এখনো চাহিদার বড় অংশ সারের জোগান আসে আমদানির মাধ্যমে। কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কা এবার কৃষির গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদান সার নিয়ে তৈরি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিটুজি চুক্তির আওতায় ৯ লাখ টন আর কাফকো বাংলাদেশ হতে সাড়ে ৫ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বিসিআইসি। যা থেকে কাফকো, বাংলাদেশ হতে আমদানির সাড়ে ৫ লাখ টনের মধ্যে এরইমধ্যে ৩ লাখ টনের জন্য এলসি খোলা হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকে। বাকি পরিমাণের জন্য এলসি খুলতে হবে আগামী জুনের মধ্যেই।
আমন মৌসুমে সাড়ে ৭ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হবে। এরপর আসবে সবচেয়ে বড় ফসল- বোরো উৎপাদনের মৌসুম, তখন মোট সার সরবরাহের ৬০ শতাংশ ব্যবহারের চাহিদা থাকবে।
সার আমদানির জন্য সরকার বিশেষ করে অর্থ বিভাগ বিসিআইসিকে কাউন্টার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। গ্যারান্টির বিপরীতে ব্যাংকগুলো ছয় মাস মেয়াদে এলটিআর (ট্রাস্ট রিসিপ্টের বিপরীতে ঋণ) সৃষ্টির মাধ্যমে সারের মূল্য পরিশোধ করে। গেল ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের অনুকূলে ৪ হাজার কোটি টাকার কাউন্টার গ্যারান্টি ইস্যু করেছে সরকার। যার বিপরীতে ২০০৬ কোটি টাকার এলটিআর দায় সৃষ্টির মাধ্যমে ইউরিয়া সারের মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। বর্তমানে কাউন্টার গ্যারান্টির লিমিট ১ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা এখনো বাকি রয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ২.১০ লাখ টন ও অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ০.৯০ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। এসব এলসি’র বিপরীতে কাফকো, বাংলাদেশের পাওনা ১০৪.৬৭ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কাছে পাওনা ৭৫.৯২ মিলিয়ন ডলার আর অগ্রণী ব্যাংকের কাছে ২৮.৭৪৮ ডলার। এই অর্থ সময়মতো দিতে না পারলে সমস্যা হতে পারে বাকি আড়াই লাখ টন সার আমদানি প্রক্রিয়ায়। যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হতে পারে বড় হুমকি।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, সারের যে চাহিদা এটা আমরা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেই বুঝতে পারবো। এখন পর্যন্ত কোনো এলাকায় সারের সংকট তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, সম্প্রতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সার ও জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজনীয় ডলার দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয় তা সমাধানে প্রয়োজনে উদ্যোগ নেয়া হবে।
এদিকে পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, সার উৎপাদনকারী কারখানাগুলো চালু রাখতে হলে দৈনিক ৩১৬ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস দরকার। কিন্তু কারখানাগুলো পাচ্ছে ১৫৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। যে কারণে সবগুলো কারখানায় উৎপাদন চালু রাখা সম্ভব নয়। গত ডিসেম্বর মাসে দৈনিক ৩,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে পেট্রোবাংলা, এরমধ্যে ৭৫০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য অস্থিতিশীল হওয়ায় এলএনজি সরবরাহ সীমিত করে সরকার, ফলে দৈনিক সরবরাহ ২,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। বর্তমানে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে মাত্র ৪৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে।
যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড জানান, চলতি অর্থবছরে সাড়ে ৪ লাখ টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিন মাস যদি কারখানা বন্ধ থাকে তাহলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। পূর্ণ সক্ষমতায় চললে কারখানাটি দিনে ১,৭০০ টন সার উৎপাদন করতে পারে।
বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের সময়ে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয় সরকার, যা এখন আসন্ন সার সংকটে হুমকির মধ্যে পড়েছে। আমদানির বড় দুই উৎস দেশ- রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে সার আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে।
কানাডা, সৌদি আরব, চীন, মরক্কো, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির ?সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব উৎসেও সারের দাম বেড়েছে। বাড়তি দামের চাপ পড়বে ইতিমধ্যে দোদুল্যমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে। এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সৌদি আরব, কাতার ও দুবাইয়ের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। যেখান থেকে নিয়মিত সার আমদানি করা হয়।