রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে ডলারের দর নিয়ে আবারো কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রণোদনাসহ রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা পর্যন্ত দিতে পারবে। কোনো ব্যাংক এর চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ব্যাংকগুলো যে দরেই ডলার কিনুক না কেন, বিক্রি করতে হবে সর্বোচ্চ ১১১ টাকায়। আর ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত রেমিট্যান্সের ১০ শতাংশ অবশ্যই আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বিক্রি করতে হবে।
রেমিট্যান্সের ডলারের দর ১২৪ টাকা পর্যন্ত উঠে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে ওই বৈঠক আহ্বান করা হয়। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকটি ডাকা হয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।
বৈঠকে অংশ নেয়া ব্যাংক এমডি ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, দেশে ডলার সংকট নিয়ে গত এক বছরে বাফেদা ও এবিবির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু সংগঠন দুটির নেয়া কোনো সিদ্ধান্তই বাজারে কার্যকর হয়নি। উল্টো কিছু সিদ্ধান্ত ‘চাপিয়ে দেয়ার ঘটনায়’ বাফেদা ও এবিবির শীর্ষ নেতাদের ওপর সদস্যদের ক্ষোভও তৈরি হয়েছে। অনেক ব্যাংকের এমডি সংগঠন দুটির নেতাদের এড়িয়েও চলছিলেন। শেষ পর্যন্ত নিজেদের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার জন্য বাফেদা ও এবিবির নেতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে নিয়ে বৈঠকে বসেন গভর্নর।
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন ২০২২ সালের শুরু থেকে এবিবির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। আর পদাধিকারবলে বাফেদা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম।
এবিবি চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন গতকালের বৈঠক শেষে গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে আমরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ সমস্যা সমাধানে আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আমাদের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক চাইলে ১১৬ টাকা পর্যন্ত দরে রেমিট্যান্স কিনতে পারবে। কিন্তু ১১১ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না। তার পরও যারা নির্দেশনা ভঙ্গ করছেন, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা সবাই মিলে ডলারের বাজার স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসব।’
আমদানিকারকরা কেন নির্ধারিত দামে ডলার পাচ্ছেন না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো আমদানিকারকের এমন কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসে জানাতে হবে। তাছাড়া সব বিষয়ে লাইন বাই লাইন লিখিতভাবে নির্দেশনা দেয়া যায় না।’
এবিবি ও বাফেদার নেতারা সংগঠন দুটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহায়তা চাইতে এসেছিলেন বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ‘আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের দর কত হবে, সেটি নিয়ে এবিবি ও বাফেদার পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। সেসব সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। আমরা জানিয়েছি, সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। নির্দেশনার বাইরে কোনো ব্যাংক অথবা এক্সচেঞ্জ হাউজ ডলার কেনাবেচা করলে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এ বিষয়টি আগের চেয়ে শক্তভাবে তদারকি করা হবে।’
মেজবাউল হক বলেন, ‘কোনো ব্যাংক চাইলে ঘোষিত দরের চেয়ে অতিরিক্ত আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারবে। কেউ যদি বেশি দামে ডলার কেনে, তাহলে সর্বোচ্চ ১১১ টাকায় বিক্রি করতে হবে। অন্যথায়, বাংলাদেশ ব্যাংক আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’
এর আগেও ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনায় দেশের বেশকিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের নেয়া সিদ্ধান্তের ওপর অটল থাকতে পারেনি। রেমিট্যান্সের অস্বাভাবিক পতনের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
বাফেদা ও এবিবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রেমিট্যান্স আনার জন্য ব্যাংকগুলোর ডলারপ্রতি সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দেয়ার কথা। যদিও গত মঙ্গলবার দেশের অনেক ব্যাংক ডলারপ্রতি ১২৪ টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত পরিশোধ করেছে। ঘোষিত দরের চেয়ে ১২-১৪ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে ডলার কেনার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডলার বাজারের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার ‘সংকট আরো তীব্র; ১২৪ টাকায়ও রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ব্যাংক’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ করে বণিক বার্তা। প্রতিবেদনে বিদেশী বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে ১২৩-১২৪ টাকায় রেমিট্যান্স কেনার বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে ডলারের দর নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আবারো কঠোর অবস্থান নেয়ার ঘোষণা দেয়া হলো।
গতকালের বৈঠকে অংশ নেয়া দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেছেন, এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত আগেও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ডলারের তীব্র চাহিদার কারণে সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। বাফেদা ও এবিবির নেতারা বলছেন, ১১৬ টাকায় রেমিট্যান্সের ডলার কেনা যাবে। কিন্তু আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করতে হবে ১১১ টাকায়। এটি পুরোপুরি অবাস্তব সিদ্ধান্ত। কারণ কেউ জেনেবুঝে লোকসানে ডলার বেচবে কেন? লোকসান করার চেয়ে রেমিট্যান্স না কেনাই ভালো। এটি হলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ আবারো হুন্ডিতে চলে যাবে।
দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়া শুরু হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় বাফেদা ও এবিবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডলার লেনদেনে সর্বোচ্চ দর বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোয় বিশেষ পরিদর্শন চালানো হয়। বেশি দামে ডলার লেনদেনে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দেশী-বিদেশী ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব তৎপরতার মুখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক ধাক্কায় রেমিট্যান্স ৫০ কোটি ডলার কমে যায়। ২০২২ সালের আগস্টে ২০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে এলেও সেপ্টেম্বরে তা ১৫৩ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। এরপর থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখনই ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কঠোর হয়েছে, তখনই বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় দেখা গেছে।
চলতি বছরের আগস্টেও বেশি দামে ডলার বেচাকেনা ঠেকাতে দেশের ব্যাংকগুলোয় বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে জরিমানা করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অভিযানের মধ্যেই রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার, যা ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে যেকোনো মূল্যে রেমিট্যান্স আনার জন্য উৎসাহিত করা হয়। এতে গত মাসে (অক্টোবর) দেশের রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারে। মূলত ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি পরিশোধের কারণেই গত মাসে রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বনিক বার্তা