ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা

২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরপর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তখন থেকে নোবেল পুরস্কারের পিছু নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হওয়ার পর বহুলোককে ধরেছিলেন পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করতে। জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো  শিঞ্জে আবে তাঁর অনুরোধে তেমন একটি চিঠি লিখেওছিলেন। ট্রাম্প নিজে বেশ গর্ব করেই বলেছিলেন, আবে তাঁর জন্য পাঁচ পাতার যে চিঠি নোবেল কমিটির কাছে পাঠিয়েছেন, সেটি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় উপহারের একটি। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি, নোবেল পুরস্কার তাঁর জন্য সোনার হরিণ হয়েই থেকেছে। তবে এবার ভাগ্য বদলাতেও পারে।

এই সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে এসেছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নৈশভোজের নিমন্ত্রণ গিয়েছিলেন। টেবিলের দুই ধারে দুই দেশের ডজন দুয়েক গণ্যমান্য ব্যক্তি, খানা শুরুর আগেই হঠাৎ বেশ নাটুকে কায়দায় পকেট থেকে একখানা চিঠি বের করলেন নেতানিয়াহু। জানালেন তিনি ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করে নোবেল কমিটির কাছে চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠির কপি। ‘একের পর এক দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন ট্রাম্প, এই পুরস্কার তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য।’

দৃশ্যত বিস্মিত হয়েছিলেন ট্রাম্প। জানালেন এই সুপারিশে তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছেন। কিন্তু সন্দেহও ছিল। নোবেল কমিটির ‘লিবারেল’ সদস্যরা কি আর আমাকে এই পুরস্কার দেবে?

এর আগেও ট্রাম্প নোবেল কমিটির আপাতপক্ষপাতিত্বে তাঁর মনঃপীড়ার কথা বলেছেন। ২০২০ সালে লাস ভেগাসে এক অনুষ্ঠানে তিনি এমন কথাও বলেন, তাঁর নাম যদি ওবামা হতো তাহলে চোখের পলকেই তিনি এই পুরস্কার পেতেন।

নোবেল কমিটির নীতিমালা অনুসারে, যেসব ব্যক্তি বা সংগঠন দেশে দেশে বন্ধুত্ব বাড়াতে, পৃথিবী থেকে নিয়মিত সেনাবাহিনীমুক্ত করতে অথবা শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে, তারাই এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবে। যাঁরা মনোনয়ন পাঠাতে পারেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিবর্গ বা শীর্ষস্থানীয় বিচারপতিরা। এর বাইরেও কমিটির নিজের অনুমোদিত ব্যক্তি ও সংস্থা রয়েছে, যারা নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ পাঠাতে পারে।

এ বছর নেতানিয়াহু ছাড়াও পাকিস্তান ট্রাম্পকে এই পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেছে। গত মাসে হোয়াইট হাউসে দুপুরের খানা খেতে এসে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আসিফ মুনির তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো সে সুপারিশের একটি কপি ট্রাম্পকে হস্তান্তর করেন।

আমরা জানি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধে তাঁর ভূমিকার জন্য ইসলামাবাদ ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেছে। কিন্তু নেতানিয়াহু কোনো বিশেষ শান্তি উদ্যোগের জন্য নয়, বিশ্বশান্তির প্রবক্তা হিসেবেই ট্রাম্পের নাম প্রস্তাব করেন। স্মরণ করা যেতে পারে, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য এই মনোনয়ন পাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ৩০ হাজার পাউন্ডের ডজনখানেক বোমা বর্ষণের নির্দেশ দেন।

ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো যুদ্ধ নেই। কোনো আশু হুমকি রয়েছে, সে কথাও কেউ বলবে না। বরং উল্টো, ইরানের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি পারমাণবিক অস্ত্র সংবরণ চুক্তি সম্পাদনের কাজে দুটি দেশ তাদের আলোচনায় বেশ এগিয়ে ছিল। এরই মধ্যে বোমা। তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, এমন সগৌরব দাবি ট্রাম্প নিজেই করেছিলেন, যদিও পরে সে দাবি সঠিক নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সম্ভবত নোবেল পুরস্কারের কথা মাথায় রেখেই ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় দফায় তিনটি জটিল আন্তর্জাতিক সমস্যা মোকাবিলার পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রশ্ন তিনটি হলো ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির নবায়ন, গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ সমাপ্তি। তাঁর ‘ব্যক্তিগত কূটনীতি’-এর সাফল্যের ব্যাপারে ট্রাম্প এতটাই আস্থাবান যে ক্ষমতা গ্রহণের এক দিনের মধ্যেই সমস্যাগুলো সমাধান করবেন, এমন আগাম ঘোষণাও দিয়েছিলেন।

বলা বাহুল্য, ইউক্রেনে এখনো রাশিয়া দেদার মানুষ মেরে চলেছে, গাজার গণহত্যা বন্ধের কোনো লক্ষণ নেই, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি আপাতত শিকেয় তোলা আছে। তারপরও কেন ভাবা হচ্ছে এই পুরস্কারের জন্য ট্রাম্প একজন যোগ্য ব্যক্তি?

মনে রাখা উচিত, এই সুপারিশগুলো আসছে এমন ব্যক্তি বা দেশের কাছ থেকে যারা তৈলমর্দনের মাধ্যমে ট্রাম্পের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বা যুদ্ধনীতি কোনোটাই এখন আর ব্যাপক-আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নয়, একা ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নির্ধারিত হয়। তিনিই ঠিক করেন, কখন কোন দেশকে নিজের নবতম অঙ্গরাজ্য বানাবেন, কোথায় বোমা ফেলবেন, কার ওপর বাণিজ্য শুল্ক বসাবেন।

ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, তিনি কী করবেন, সে কথা একা তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। সব বিষয়েই তিনি অন্য সবার চেয়ে বেশি জানেন, বেশি বোঝেন। যেমন তিনি নিজেই বলেছেন, যুদ্ধসংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্ন তিনি জেনারেলদের চেয়েও বেশি জানেন। জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে আলাদা কোনো উপদেষ্টাও তিনি এবার নিয়োগ দেননি। এর ফলে পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে অনেক কিছুই একতরফা ও অপরিকল্পিত। তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এতটাই বিশৃঙ্খল যে আজ তিনি এক কথা বলেন, তো ২৪ ঘণ্টা পর ঠিক তার উল্টো কথা বলেন।

কোনো কোনো পণ্ডিতজন তাঁর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে পাগলামি বলেও উপহাস করেছেন। ইউরোপীয় দেশগুলো তাঁর এই খামখেয়ালি ব্যবহারে এতটাই উদ্বিগ্ন যে তারা ট্রাম্পকে খুশি রাখতে এখন চাতুরীর আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছে। ন্যাটোর মহাসচিব গত মাসে তাঁর শান্তি উদ্যোগের প্রশংসা করতে গিয়ে মুখ ফসকে ‘ড্যাডি ট্রাম্প’ বলে ফেলেছিলেন। সন্দেহ নেই, সেটিও তৈলমর্দনেরই অংশ।

ট্রাম্পের এই অভিনব ‘ব্যক্তিগত কূটনীতি’র পেছনে এমন একটি বিশ্বাস কাজ করে যে বিবদমান দেশগুলোর নেতাদের কারও কারও সঙ্গে তাঁর সখ্য এত নিকট ও গভীর যে তিনি চাইলে তাদের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। যেমন তাঁর দাবি অনুসারে, ঘটেছে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে। তবে অন্য অধিকাংশ ব্যাপারে সে কথা সত্য প্রমাণিত হয়নি। এমনকি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও অর্থের ওপর নির্ভরশীল, তিনিও ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি দাবি উপেক্ষা করে গাজায় গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড’ বলে তিনি যতই ঢোল পেটান না কেন, ট্রাম্পের দাবি মেনে এখন পর্যন্ত শান্তি আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি।

তবে এ কথা অংশত ঠিক যে গাজা ও ইউক্রেন প্রশ্নে নতুন আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন ট্রাম্প। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সম্পাদনে স্পষ্ট আগ্রহও দেখিয়েছেন তিনি, অদূর ভবিষ্যতে সে আলোচনা আবার শুরু হবে, এ কথা ভাবা অযৌক্তিক নয়।

গাজা প্রশ্নে ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব শুধু অবাস্তবই নয়, ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য তা অপমানজনক। তা সত্ত্বেও কোনো কোনো আরব দেশ, বিশেষত মিসর, কাতার ও সৌদি আরব, ট্রাম্পের উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে যুদ্ধ বন্ধে আলোচনায় বসতে ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই সম্মতি দিয়েছে, কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে। এমনকি ইয়েমেনের হুতিদের সঙ্গে একটি আলাদা শান্তি সমঝোতায় পৌঁছানো গেছে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অনুমোদনে।

শুধু ট্রাম্প চান বলেই এসব বিভিন্ন প্রশ্নে ভোজবাজির মতো সমাধান অর্জিত হবে, তা নয়। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ, জটিল ও বহুপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা। তেমন আলাপ-আলোচনার মানুষ ট্রাম্প নন, কিন্তু তিনি যদি এ কথা বুঝতে সক্ষম হন যে তার ব্যক্তিগত প্রভাব ব্যবহার করে অর্থপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো সম্ভব, তাহলে হয়তোবা নিকট ভবিষ্যতে এসব প্রশ্নেই অগ্রগতি অর্জন সম্ভব। ট্রাম্প যাতে সেই পথে আসেন, হয়তো সে জন্যই বিশ্বের কোনো কোনো নেতা ট্রাম্পের নাকের ডগায় নোবেল শান্তি পুরস্কারের মুলোটি ঝোলাতে চাইছেন।

২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ পাঠানোর তারিখ ছিল ফেব্রুয়ারি। ফলে এ বছর ট্রাম্পের নাম বিবেচিত হবে, সে কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে ফিলিস্তিন ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উদ্যোগ কোনো সাফল্য বয়ে আনে, তাহলে নোবেল পুরস্কারের সোনার হরিণটি তিনি আগামী কোনো সময়ে পেলেও পেতে পারেন।

  • হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক

Source: Prothom Alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here