হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে ভারতের বর্তমান সরকার যে অত্যন্ত খুশি, তা বলার অপেক্ষাই রাখে না! ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুধু পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাই নয়, তারা দুজনেই একাধিকবার প্রকাশ্যে সে কথা বলেছেন। আর মোদি তো ২০২০ সালে আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’ স্লোগান পর্যন্ত দিয়েছেন, কোনও কূটনৈতিক রীতিনীতির পরোয়া করেননি।
এবারে মার্কিন নির্বাচনের ঠিক আগেও ট্রাম্প তার ‘বন্ধু’ মোদির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর সেই তারিফের দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিয়েছেন মোদি।
এখন নরেন্দ্র মোদি ৩.০ ও ডোনাল্ড ট্রাম্প ২.০ যখন সমান্তরালে চলবে, তখন সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর নিশ্চিতভাবেই ছায়াপাত করবে– আর সেটি হলো বাংলাদেশ!
আসলে সাম্প্রতিক অতীতে, বিশেষ করে বাইডেন আমলে বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার যে অবস্থান ছিল, তা ভারতের মনঃপূত হয়নি নানা কারণে। কোয়াড (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সমন্বয়ে গঠিত জোট) জোটে ভারত ও আমেরিকা শরিক হতে পারে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ ইস্যুতে দুই দেশের মতপার্থক্য কিন্তু বারে বারেই সামনে চলে এসেছিল।
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অবস্থান ছিল, তারা এখানে শান্তি, স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি ও প্রগতিশীলতার পক্ষে, যা মূলত শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন বলেই পর্যবেক্ষকরা ধরে নিতেন। অন্যদিকে আমেরিকার বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ, নির্বাচন অবাধ নয় এবং মানবাধিকার পরিস্থিতিও অত্যন্ত শোচনীয়, অবিলম্বে যার সংস্কার দরকার। ফলে বাংলাদেশ ইস্যুতে এই দুই বন্ধু দেশের মতান্তর ও মনান্তর গোপন থাকেনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে সেই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলেই দিল্লি প্রত্যাশা করছে। এই ধারণার ভিত্তি হলো ট্রাম্পের অতীত ট্র্যাক রেকর্ড! ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি (পাকিস্তান ছাড়া) নিয়ে তিনি আগেও বিশেষ মাথা ঘামাননি, এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
সদ্যসমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনও কোনও জায়গায় প্রভাব ফেলতে পারে––সে প্রশ্নের জবাবেও তারা কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করছেন।
বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকা ভারতের পরামর্শ শুনবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন যে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দেবে, সে ব্যাপারে দিল্লিতে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রায় সবাই একমত।
“যতই বলা হোক যে আমেরিকায় ক্ষমতার পালাবদল হলেও সে দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটা ধারাবাহিকতা ও ‘বাইপার্টিজান’ ঐকমত্য থাকে, আমরা সবাই জানি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সে কথাটা সত্যি নয়’, বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিবিদ, যিনি ওয়াশিংটনেও ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ফলে বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ নিয়ে যে পরিমাণ ‘আগ্রহ’ ও ‘গরজ’ দেখিয়েছে– ট্রাম্প জমানায় তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাবে না বলে তিনি ইঙ্গিত করছেন। এর কারণটাও সহজ––ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে এরকম ‘হস্তক্ষেপে’র পেছনে অর্থ ঢালাকে অপচয় বলেই ধরা হয়!
আসলে ভারতে অনেকেই যেটা বিশ্বাস করেন, তা হলো ট্রাম্প তার ২.০ মেয়াদে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি থেকে হয়তো আমেরিকাকে অনেকটাই সরিয়ে নেবেন। যার অর্থ হলো এই অঞ্চলে ভারত আবার তাদের নিজস্ব প্রভাব বলয় তৈরির সুযোগ পাবে।
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিবিদ সৌমেন রায়ের কথায়, ‘ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও আমরা দেখেছি তিনি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে মৌনই থেকেছেন– সেটা কাশ্মিরই হোক বা নাগরিকত্ব আইন। কাশ্মিরে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলেও তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে ভারত না-চাইলে তিনি এর মধ্যে কখনোই ঢুকবেন না।’
সেই অভিজ্ঞতা থেকে এটা ধারণা করা যেতেই পারে যে ভারতের ‘ইমিডিয়েট নেইবারহুডে’ অবস্থিত বাংলাদেশ প্রসঙ্গেও ট্রাম্প প্রশাসন এক ধরনের নির্লিপ্ত অবস্থান নেবে এবং বাইডেন জমানার মতো কখনোই ‘অতি-সক্রিয়তা’ দেখাবে না– বলছেন সৌমেন রায়।
বস্তুত এটা দিল্লিতে অনেকেই মানেন যে ২০০৯ সাল থেকে ওবামা প্রশাসনের সময়ও আমেরিকা বাংলাদেশকে প্রধানত ভারতের চোখ দিয়েই দেখতে অভ্যস্ত ছিল। ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় আসার পরও সেই দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ২০২১ সালে জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাট প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আমেরিকা কিন্তু ভারতকে এড়িয়ে সরাসরি বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ দেখাতে থাকে।
ঠিক এক বছর আগেকার নভেম্বরে দিল্লিতে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের ‘টু প্লাস টু’ সংলাপেই দুই দেশের এই মতপার্থক্য সামনে চলে আসে। সেই বৈঠকের পর ভারত প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয় যে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অবস্থান (ভারত সে দেশে শান্তি-সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও প্রগতিশীলতার পক্ষে) আমেরিকার কাছে ‘স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে’। অথচ আমেরিকা সেই প্রসঙ্গে একটি কথাও বলেনি, যৌথ বিবৃতিতেও ঠাঁই পায়নি বাংলাদেশ বৃত্তান্ত!
বাংলাদেশ নিয়ে ভারত-আমেরিকার মধ্যে এই ধরনের তিক্ততা ও মতবিরোধ ট্রাম্প জমানায় নাটকীয়ভাবে কমে যাবে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ইস্যু
৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর ‘নির্যাতন চলছে’ বলে ভারত সরকার ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বারবার বলে আসছে, ট্রাম্পের বিজয় সেই পরিস্থিতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বস্তুত বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগগুলো নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ড. ইউনূসের সরকারকে ছাড় দিতে প্রস্তুত নন, তা তিনি নিজেই নির্বাচনের আগে এ প্রসঙ্গে টুইট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আমেরিকায় বিজেপির শাখা (ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অব বিজেপি) সংগঠনের অন্যতম প্রধান নেতা যুধাজিত সেন মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘ট্রাম্পের আগে আর কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে হিন্দুদের সুরক্ষার দাবিতে এভাবে সরব হননি। দীপাবলির (কালীপূজা) আগে তিনি যেভাবে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে নিয়ে এই ইস্যুতে তীব্র সমালোচনা করেছেন, তা আমাদের নজর এড়ায়নি!’
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন কংগ্রেসম্যান রাজা কৃষ্ণমূর্তিও ইতোমধ্যে বাংলাদেশি হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য মার্কিন প্রশাসনের কাজে আর্জি জানিয়েছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট যাতে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন সে জন্যও প্রতিনিয়ত উদ্যোগ নিচ্ছেন তিনি।
দিল্লিতে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে ড. ইউনূসের সরকার এক ধরনের ‘ডিনায়াল মোডে’ (পুরোপুরি অস্বীকার করার অবস্থানে) আছে– তারা এই গুরুতর বিষয়টিকে অতিরঞ্জন, ফেক নিউজ বা রাজনৈতিক কারণে হামলা বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যেহেতু হিন্দু ভারতীয়-আমেরিকানদের একটা বড় অংশের সমর্থন পেয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করবেন না এবং সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখবেন বলেই ভারতের ক্ষমতাসীন দল প্রত্যাশা করছে।
শেখ হাসিনার কী হবে?
গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে ভারতের আতিথেয়তায় রয়েছেন বাংলাদেশের অপসারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলেও তার অবস্থায় এখনই কোনও নাটকীয় পরিবর্তন আসবে বলে ভারতে বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক মনে করছেন না।
ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন, এমন একজন সাবেক কূটনীতিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, “শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রহ বা সময় থাকবে, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। তার আমলে হয়তো বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার ‘ইন্টারেস্ট’ কমে আসবে, যেটাকে বড়জোর একটা শেখ হাসিনার জন্য ইতিবাচক লক্ষণ ধরা যেতে পারে!”
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রভাবশালী জামায়াতে ইসলামীর প্রতি আমেরিকার ডেমোক্র্যাটদের মনোভাব বেশ সহজ হলেও রিপাবলিকানরা যে জামায়াতকে বেশ কঠোর দৃষ্টিতেই দেখেন, সে কথাও তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
তবে ভারতেই একটা শ্রেণি আবার মনে করছেন, ট্রাম্পের বিজয় শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পথও প্রশস্ত করতে পারে। এদেরই অন্যতম ভিকি নানজাপ্পা, যিনি ভারতের শাসক দল বিজেপি ও তাদের আদর্শিক অভিভাবক হিসেবে পরিচিত আরএসএসের ঘনিষ্ঠ একজন তরুণ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনই (৫ নভেম্বর) তিনি আরএসএসের ইংরেজি মুখপাত্র ‘দ্য অর্গানাইজারে’ একটি নিবন্ধ লেখেন– যাতে স্পষ্ট পূর্বাভাস করা হয়েছিল, হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আবার ফিরে আসেন তাহলে বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের জন্য সব দিক থেকেই সেটা এক অত্যন্ত দুরূহ পরিস্থিতির জন্ম দেবে। তার ভাষায়, সেটা হবে ‘আ ডেভিল অ্যান্ড দ্য ডিপ সি!’
ভিকি নানজাপ্পা আরও বলছেন, ট্রাম্প জেতার পর ড. ইউনূসের সরকারের জন্য পরিস্থিতি ‘অস্বস্তিকর’ হয়ে উঠতে বাধ্য। কারণ তিনি মার্কিন প্রশাসনের কাছ থেকে যে সমর্থন এতদিন পাচ্ছিলেন সেটা হারাবেন। এমনকি বাংলাদেশকে হয়তো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশনের কবলেও পড়তে হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের অপসারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ দেশে ফিরেও যেতে পারেন বলে জানানো হয়েছে এই নিবন্ধে।
যদিও এটা নেহাতই একটা ‘উইশফুল থিঙ্কিং’-এর (মনের মতো ভাবনা) বেশি কিছু নয় বলে মনে করছেন ভারতের বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক।
“শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে হলে আসলে একটা খুব জটিল ‘জিগস পাজলে’র অনেক টুকরোকে খাপে খাপে মিলতে হবে। ট্রাম্পের জয় হয়তো এই পাজলের বড়জোর একটা কোনাকে মেলাতে পারলো। কিন্তু পুরো হেঁয়ালিটার সমাধান এখনও দূর-অস্ত!”– বলছিলেন ভারতের আরেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ।
উৎস: বাংলাট্রিবিউন।