- মীযানুল করীম
- ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
মহামারীর বিরাম নেই। চলতি বছরের শুরুতে এর শুরু। এবার শীতে তার এক বছর যেমন পুরো হচ্ছে, তেমনি করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের নিষ্ঠুর করুণ তরঙ্গও বোধ হয় ধাক্কা মারছে। তবে মুদ্রার অন্য পিঠের ন্যায় আপাতত আশা করা গিয়েছিল, মারীর মুখে কিঞ্চিৎ লাগাম দিতে বোধ হয় টিকা বা ভ্যাকসিন আসছে ‘কয়েক’ মাসের মধ্যে। অবশ্য তত দিনে ঠাণ্ডার প্রকোপ পার হয়ে কয়েক মাস চলে যাওয়ার কথা। লক্ষণীয় বিষয় হলো- এ টিকা নিয়ে ‘টক্কর’ বেধেছে সরকার বনাম বেসরকারি ইস্যুতে।
করোনার টিকা সংক্রান্ত, সরকারের জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা গ্রুপ বা ‘নাইটেগ’-এর একজন সিনিয়র সদস্য একটি পত্রিকাকে জানিয়েছেন, সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যাবে, কি যাবে না, এ নিয়ে আশঙ্কার দরুন বেসরকারি উদ্যোগে টিকা আনা বা দেয়াকে সমর্থন জানানো হয়নি। অবশ্য সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সুযোগ থাকলে তাতে বরং জনগণ ও সরকার উভয়ের লাভ। বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ চিকিৎসকদের অনেকেই সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষুব্ধ। তারাও চান, টিকা আমদানির অবকাশ সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই খোলা রাখা উচিত। তাদের কথা, করোনা মহামারীর মোকাবেলা নিয়ে এ বছর যে অনিয়ম, নৈরাজ্য, বাণিজ্য, হয়রানি, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, আসন্ন বছর এর টিকা নিয়েও তা ঘটতে পারে। তাই টিকা আমদানির বিষয়টি শুধু সরকারের আওতায় রাখা ঠিক নয়। বরং, এটা উন্মুক্ত করে দিলে বিত্তবান মানুষের চাপ কমবে সরকারের ওপর। কারণ, তখন তারা গরিবের টিকায় আর ভাগ বসাবেন না। এটা গরিবের জন্য সুবিধাজনক। সরকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে নৈরাজ্য জন্ম নিতে পারে না। তবে ‘নাইটেগ’ সদস্যদের একজন বলেছেন, বেসরকারি খাতকে টিকা আনার অনুমতি দিয়ে তা বেসরকারি পর্যায়ে দেয়ার সুযোগ প্রদান করা না হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। বেসরকারি থিংকট্যাংক ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ বা সিপিডির ওয়েবিনারে যত দ্রুত পারা যায়, বেসরকারি খাতকে করোনা টিকা আমদানির সুযোগ প্রদানের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সরকারের বাইরের বিশেষজ্ঞ মহলও এ ব্যাপারে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছেন বলে জানা যায়।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব একটি দৈনিককে বলেছেন, ‘আমরা করোনা টিকার জন্য সার্বিক ব্যবস্থা নিয়েছি। এর চূড়ান্ত প্রস্তুতির কাজ চলছে। কখন টিকা আসবে, সে জন্য আমরা প্রতীক্ষা করছি। তবে আমাদের মনে হচ্ছে, সরকার একা করোনা টিকার সবকিছু সামাল দেয়া কঠিন হবে। তাই বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তাদের কেউ সরকারি নিয়ম মেনে টিকা আনতে চাইলে আমরা স্বাগত জানাই।’
করোনা টিকা আমদানিকে কেবল সরকারি খাতে রাখার প্রতি এ যাবৎ বেশি নজর দেয়া হয়েছে। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। কারণ ‘অনেকটা হঠাৎ করেই সরকারের দিক থেকে, টিকা আমদানির জন্য বেসরকারি খাতকে ডাকাডাকি শুরু হয়েছে।’ তবে তা শর্তহীন নয়। এ ক্ষেত্রে প্রধানত যে দুই শর্ত দেয়া হয়েছে, তার একটি হলো- আমদানি করা করোনা টিকা মার্কিন প্রশাসনের ওষুধ প্রশাসন দফতর বা এফডিএ কিংবা ব্রিটেন, ইইউ অথবা জাপানের সংশ্লিষ্ট সংস্থা নতুবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদনপ্রাপ্ত হতে হবে। দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নির্দিষ্ট কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। অনেকে মনে করেন, টিকা নিয়ে ‘ব্যবসা’ করা উচিত নয়। বেসরকারি খাতে তা করতে দিলে নানান নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও হয়রানি আবার জন্ম নিতে পারে। তদুপরি কারো কারো ধারণা, এখন টিকা নিয়ে এত তোড়জোড়; তবে টিকা এলে এই আগ্রহ কমে যেতেও পারে।
তা ছাড়া, করোনার টিকা নেয়া থেকে যাতে বঞ্চিত হতে না হয়, এ জন্য ঘোষিত অগ্রাধিকার তালিকার ভেতর বাইরের অনেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা তদবির, দেনদরবারে মেতে উঠেছেন। দেশের চিকিৎসকদের যারা কোভিড চিকিৎসায় জড়িত হননি, তারা আশঙ্কা করছেন- হয়তো টিকার অপর্যাপ্ততার সম্ভাবনা থাকলে তাদের অনেকে এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার থেকে বাদ পড়বেন। অবশ্য সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন, সংবাদকর্মী, প্রমুখকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে করোনা টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। এ দিকে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা ইতোমধ্যেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন এ টিকা পাওয়ার জন্য ফোনে যোগাযোগসহ বারবার অনুরোধ উপরোধে। ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিবের সাথে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। এতে স্থির হয় যে, দু-একদিনের মধ্যেই আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাথে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস শাখা প্রয়োজনীয় ডাটাবেজ প্রস্তুত করবে। নির্ধারিত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যারা টিকা পাবেন, তাদের ক্ষেত্রে যেন বিশৃঙ্খলা না হয়, তা নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য।
এক দিকে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে সরকার-বেসরকারি দ্বন্দ্ব; অন্য দিকে ভ্যাকসিন এলে কখন আসতে পারে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি ও দুশ্চিন্তা। একবার বলা হচ্ছে, জানুয়ারি মাসে (অর্থাৎ শীতের চরম মুহূর্তে) ভ্যাকসিন এ দেশে চলে আসবে। কারণ, সরকার আগেই এর বিপুলসংখ্যক ডোজের অর্ডার দিয়ে রেখেছে। আবার সরকার সমর্থক মিডিয়ারই খবর, শীত পার হয়ে যাওয়ার অনেক পরে, সামনের বছরের মাঝামাঝি সময়ে এ টিকা বা ভ্যাকসিন আসবে। অন্তত নাকি মে মাস পর্যন্ত তা ‘পাবে না দেশের মানুষ’! জুন মাসে গরম কাল শেষ হয়ে বর্ষা আরম্ভ হয়ে যায় বাংলাদেশে। এবারকার শীত চলে গেলে শিক্ষিত মানুষের করোনা-ভীতি অনেকটা কমে যাবে। কারণ উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতে করোনা অণুজীব সুবিধা করতে পারে না। যেখানে উন্নত দেশগুলোর মানুষ সবাই ভ্যাকসিন পেতে পেতে আরো কয়েক মাস লেগে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রের অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে, সহজেই অনুমেয়। কেবিনেট সেক্রেটারি বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বরাতে, ‘মে-জুন মাসের মধ্যে কোভেক্সের মাধ্যমে আরো ছয় কোটি টিকা আসবে। তবে এক মাস আগে পরে হতে পারে। প্রথম দফায় যে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসার কথা, তার অর্ধেক আসছে। দ্বিতীয় দফায় আসবে তিন কোটি মানুষের টিকা। দেশের ২০ শতাংশ মানুষকে এ টিকা দেয়া যাবে। সব মিলিয়ে, সাড়ে চার কোটি মানুষকে করোনার ভ্যাকসিন দেয়া যাবে।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে অন্তত ১৫ কোটির মতো।
আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে করোনার টিকা দেয়া শুরু হয়ে গেছে বেশ ক’দিন আগেই। প্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশীও তা পেয়েছেন। একজন আমেরিকাপ্রবাসী ডাক্তার জানান, প্রথম সপ্তাহে এ মাসে বাংলাদেশী স্বাস্থ্যকর্মীদের ১০ শতাংশেরও কম এ টিকা নিতে পেরেছেন। সে দেশে করোনায় চার শতাধিক বাংলাদেশী মারা গেছেন যাদের তিন-চতুর্থাংশই নিউ ইয়র্কের। ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৩৮ হাজার মানুষ করোনার টিকা দিয়েছেন। দু’ডোজের দ্বিতীয়টি নিতে হবে চার সপ্তাহ পরে।
আমরা কখন করোনার ভ্যাকসিন বা টিকা পাই, তার ঠিক নেই। যতই সরকার বলুক অত কোটি টাকা জমা দিয়ে অত কোটি টিকার অগ্রিম অর্ডার বুকিং করে রাখা হয়েছে। সত্য হচ্ছে- সরকার নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে না যে, ‘অমুক মাসে এতগুলো করোনা ভ্যাকসিন আমরা পাবোই।’ কারণ অনেক কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটাই জাতির নসিব বা নিয়তি। ক্ষুদ্র নগর দেশ সিঙ্গাপুর গত সোমবার ২১ ডিসেম্বর এ টিকা পেয়ে গেছে, আর আমাদের দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একই দিন জানিয়েছেন মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে- ‘জুনের মধ্যে ৯ কোটি টিকা আসবে।’ অর্থাৎ আরো অন্তত ছয় মাস বা অর্ধবর্ষ পরে।
এখন ‘ন’মণ তেল পুড়ে হলেও রাধা নাচলেই’ যথেষ্ট। কেননা, এ দেশের দুর্ভাগা দরিদ্র জনগোষ্ঠী আসলেই ‘ঘরপোড়া’। ওরা চতুষ্পদ না হয়েও জীবন যাপন করতে হয় মানবেতর। তাদের জন্য দরকার সাশ্রয়ী, সুলভ, কার্যকর, নিরাপদ ও টেকসই টিকা। তাই করোনা ভ্যাকসিন যুগপৎ হতে হবে পরিবেশবান্ধব ও দরিদ্রবান্ধব। অন্যথায়, মিথ্যা হয়ে যাবে ‘Corona is a great equalizer’ (করোনা হলো, এক বিরাট সমতা সৃষ্টিকারী) কথাটা। এমনিতেই শোষণ-বৈষম্যে এ সমাজের বণ্টনব্যবস্থা সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক নয়। করোনার টিকা তা যেন কমাতে পারে, সে জন্য অন্তত আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সরকার ও সুশীলসমাজ এগিয়ে আসা উচিত।
মিডিয়ার খবর, এশিয়া মহাদেশে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রথম টিকার চালান পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও সম্পদে ও জীবনমানে ‘বৃহৎ’- এমন নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের এ ভ্যাকসিন প্রস্তুত করেছে ফাইজার-বায়োএনটেক। খোদ সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিল, দু’তিন সপ্তাহ পরে আসবে এ টিকা। সিঙ্গাপুরের বিমান এ ওষুধ এনেছে বেলজিয়াম থেকে। মাত্র আগের সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সিঙ্গাপুরের অনুমতি পেয়েছে। ওই দেশের জনসংখ্যা মাত্র ৫৭ লাখ এবং দুনিয়ার যে কয়েকটি দেশে করোনায় মানুষ মারা গেছে সবচেয়ে কম, তার মধ্যে একটি হলো সিঙ্গাপুর। টিকা পেয়ে ফেসবুকে উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং (৬৮) বলেন, ‘সবার আগে যারা এ টিকা নেবেন, আমি তাদের অন্যতম।’ মানুষকে করোনা ভ্যাকসিন নিতে নিজেও উৎসাহ জোগানোর উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘টিকা নেয়া স্বেচ্ছামূলক কাজ।’ প্রথমে তা দেয়া হবে স্বাস্থ্যকর্মী ও বয়স্কদের।
সিঙ্গাপুরে কয়েক মাস ধরে করোনার ‘নতুন স্থানীয় সংক্রমণ’ নেই বলা যায়। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিধিনিষেধ আরো উঠে যাবে আগামী সপ্তাহে। সিঙ্গাপুর এ টিকা কেনার জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে অগ্রিম চুক্তি করেছে দাম দিয়েই। এর মধ্যে মডার্না ও সিনোভ্যাক আছে। করোনার টিকা প্রদানের জন্য ৭৪৬ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার বা এক বিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে।
অপর দিকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনাগ্রহী, এমনকি মাস্ক পরিধানে অনিচ্ছুক, কোটি কোটি মানুষের বাংলাদেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। আর দেশে শনাক্তকৃত করোনারোগী পাঁচ লাখেরও বেশি। এখানে দিনে ২০-৩০ জন করে করোনায় মৃত্যুবরণের পাশাপাশি, শনাক্ত হচ্ছেন হাজার খানেক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে তিন কোটি ডোজ টিকা আসছে। মে ও জুন মাসের মধ্যে আসবে আরো ছয় কোটি ডোজ করোনা টিকা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব কেবিনেট মিটিংয়ের পর অনুষ্ঠিত নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ কথা জানিয়েছেন।
এ দিকে, ব্রিটেনের মূলত দক্ষিণাঞ্চলে নতুন ধরনের আগ্রাসী করোনা ছড়িয়ে পড়ায় ভয়াবহ আতঙ্কের জন্ম হয়েছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের বিমান যোগাযোগ ব্রিটেনের সাথে স্থগিত রাখা হয়েছে। ইতালি আগে থেকেই করোনা-বিপর্যস্ত। সে দেশ থেকে ইতালিতেও নতুন টাইপের করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। তবু ইইউ বলেছে, ‘বিধি-নিষেধে আর কড়াকড়ি করা হবে না।’ তবে ঢাকা-লন্ডন বিমান যোগাযোগ বন্ধ হওয়াও বিচিত্র নয়।