ডলারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিপরীতে টাকার মান অস্বাভাবিক হারে কমতে শুরু করেছে। দেশে ডলারের তীব্র সংকটের কথা বাইরের দেশগুলোতে প্রচারিত হওয়ার পর বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো টাকার মান কমিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মুদ্রার মান বাড়িয়ে দিয়েছে।
একদিকে বৈদেশিক দেনা পরিশোধে ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করছে, অন্যদিকে এর দাম বেড়ে যাচ্ছে লাগামহীনভাবে। বাড়তি দামে রেমিট্যান্স কিনেও বিক্রি করতে হচ্ছে কম দামে। এতে ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব তহবিল থেকে বাড়তি খরচের জোগান দিতে হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের লাইসেন্সধারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) নির্দেশনা অনুযায়ী এখন রেমিট্যান্স কেনার ডলারের দর সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে সরকারের প্রণোদনা আড়াই শতাংশ ও ব্যাংকের নিজস্ব প্রণোদনা আড়াই শতাংশ মিলে মোট ৫ শতাংশ প্রণোদনাসহ প্রতি ডলারের দাম হবে সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা। এই দামেই রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু কিছু ব্যাংক ওই দামে রেমিট্যান্সের ডলার না পেয়ে ১২২ থেকে ১২৭ টাকা দামেও ডলার কিনছে। প্রতি ডলারে প্রায় ৬ থেকে ১১ টাকা বেশি দিচ্ছে। কিন্তু এসব ডলার বিক্রি করতে হবে সর্বোচ্চ ১১১ টাকা করে। এতে প্রতি ডলারে ১১ থেকে ১৬ টাকা লোকসান হচ্ছে। আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে ১১৬ টাকা করে রেমিট্যান্সের ডলার কিনলেও প্রতি ডলারে লোকসান হচ্ছে ২ টাকা ৭৫ পয়সা। এই অর্থ ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করতে হবে। কিন্তু ডলারের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা যাবে না। ফলে বৈদেশিক দেনা মেটাতে ও নিজেদের সুনাম ধরে রাখতে চড়া দামে ডলার কিনে বিপাকে পড়ছে ব্যাংকগুলো। এতে তাদের মুনাফা কমে যাবে। শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়ার হারও কমবে।
রেমিট্যান্স আহরণকে কেন্দ্র করে বিদেশে বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউজ গড়ে উঠেছে। তারা প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে সেগুলো তারা ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে। নগদ ও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দুই ভাবেই তারা রেমিট্যান্স ব্যাংকের হিসাবে জমা করে। এক্ষেত্রে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে সংশ্লিষ্ট মুদ্রার বিপরীতে বেশি টাকা চাচ্ছে। কিছু ব্যাংক বেশি টাকা দিচ্ছেও। ফলে এখন যেসব ব্যাংক বেশি টাকা দিচ্ছে তারা বেশি রেমিট্যান্স পাচ্ছে। এ কারণে এখন বড় ব্যাংকগুলো যারা অফিসিয়াল দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করত তাদের প্রবাহ কমে কমে গেছে। ছোট ব্যাংকগুলোর যারা বেশি দাম দিচ্ছে তারা রেমিট্যান্স বেশি পাচ্ছে। অর্থাৎ বিদেশেও বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশেরই কিছু ব্যবসায়ী। এছাড়া বিদেশি ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন। রেমিট্যান্স সংগ্রহে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অসমপ্রতিযোগিতা দেখে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো দেশে ডলার সংকটের আঁচ করতে পারছেন। পলে তারাও রেমিট্যান্সের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৫৩ শতাংশ আসে ওইসব দেশ থেকে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। মোট রেমিট্যান্সের সৌদি আরব থেকে ১৮ শতাংশ, সংযুক্ত আর আমিরাত থেকে ১৫ শতাংশ, কুয়েত থেকে ৭ শতাংশ, কাতার থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ, ওমান থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ, মালয়েশিয়া থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৩ শতাংশ ও যুক্তরাজ্য থেকে ১১ শতাংশ আসে।
এক সপ্তাহ আগে কুয়েতি দিনারের দাম ছিল ৩৫০ টাকা। গত বৃহস্পতিবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ টাকায়। অর্থাৎ ওই দিন কুয়েতে কার্যরত এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো দিনার বিক্রি করেছে ৪০০ টাকা করে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ১৪ শতাংশ। কাতার রিয়ালের দাম এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩১ টাকা। গত বৃহস্পতিবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ টাকা। দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। কাতারের এরাবিয়ান এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ও আল জামান এক্সচেঞ্জ কোম্পানি প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে। তারা বৃহস্পতিবার প্রতি রিয়ালের দাম চাচ্ছে ৩৫ টাকা। এর কমে দিচ্ছে না। ফলে যেসব ব্যাংক ৩৫ টাকায় রিয়াল কিনলে তারাই কেবল রেমিট্যান্স পাচ্ছে।
ওমানের রিয়ালের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৯০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ। এদিকে ওমান সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের নতুন ভিসা দেওয়া স্থগিত করেছে। এতে ওমানে নতুন কর্মী যাওয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সৌদি রিয়ালের দামও ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৪ টাকা হয়েছে। মালয়েশিয়ান রিঙ্গিতের দাম ২৪ টাকা থেকে ২৬ টাকা হয়েছে।
ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৪১ টাকা। সম্প্রতি এর দাম বেড়ে ১৫১ টাকা হয়েছে। ব্রিটেনে কার্যরত বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো এখন ১৫১ টাকার কম বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে রেমিট্যান্স বিক্রি করছে না।
ডলারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিপরীতে টাকার মান অস্বাভাবিক হারে কমতে শুরু করেছে। দেশে ডলারের তীব্র সংকটের কথা বাইরের দেশগুলোতে প্রচারিত হওয়ার পর বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো টাকার মান কমিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মুদ্রার মান বাড়িয়ে দিয়েছে।
যুগান্তর