টাকার অবমূল্যায়নে অস্বাভাবিক লোকসানে বিদ্যুৎ খাত!

ইসমাইল আলী: নানা কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরে রেখেছিল সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তন করলেও দুই বছরের বেশি সময় টাকার বিপরীতে তা মোটামুটি এক জায়গায় ছিল। তবে ২০২১ সালে তা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় সরকার। এর পর থেকে ডলারের বিনিময় হার বেড়েই চলেছে, যার প্রভাব পড়ছে আমদানি ব্যয়সহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে।

ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের প্রভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বিদেশি ঋণগ্রহীতা কোম্পানি ও সংস্থাগুলো। এর অন্যতম হলো বিদ্যুৎ খাত। এ খাতের সংস্থা ও কোম্পানিগুলোকে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে। আবার ক্যাপাসিটি চার্জ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ডলারের বিনিময় হার ধরে পরিশোধ করতে হয় বিধায় রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) দ্বিগুণ লোকসান গুনতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি সংস্থা ও কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুই বছরে (২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর) ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এগুলোকে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় চার হাজার ৯২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরই সংস্থা ও কোম্পানিগুলো লোকসান দিয়েছে তিন হাজার ৭১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর এ লোকসানের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২১০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর লোকসান বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বা ২০৭ শতাংশ।

এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর ডলারের বিপরীতে টাকার নামমাত্র অবমূল্যায়ন হয়েছিল। এতে ওই অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী পাঁচ সংস্থা ও কোম্পানিগুলো মাত্র ৪৬ কোটি ৪২ টাকা লোকসান গুনেছিল। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছর টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি ২৬ গুণ বা দুই হাজার ৬০০ শতাংশ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪.৮১ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩.৪৫ টাকা ও ২০২-২৩ অর্থবছর ১০৬ টাকা। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছর ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়েছিল আট টাকা ৬৪ পয়সা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছর বেড়েছে ১২ টাকা ৫৫ পয়সা। যদিও বর্তমানে এ হার ১১০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় গত অর্থবছর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় পিডিবির। সংস্থাটি গত অর্থবছর এ খাতে এক হাজার ৫৫০ কোটি সাত লাখ টাকা লোকসান গুনেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর এ খাতে পিডিবির লোকসান ছিল ৬১১ কোটি ৫৯ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পিডিবির লোকসান বেড়ে আড়াইগুণ ছাড়িয়েছে। তবে ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি ছিল মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির এ খাতে লোকসান বেড়েছিল প্রায় ৪৫৮ গুণ।

সারাদেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) গত অর্থবছর ডলারের মূল্যমান বৃদ্ধিতে ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ২৭৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর পুরোটাই গেছে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে। ২০২১-২২ অর্থবছর এ খাতে পিজিসিবির লোকসান ছিল ৫৩৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ কোম্পানিটির টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি এক বছরে প্রায় ১৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ২০২০-২১ অর্থবছর পিজিসিবির টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি ছিল ৩৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছর পিজিসিবির এ খাতে লোকসান বেড়েছে প্রায় ১৫ গুণ।

ঢাকার উত্তর অংশে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ২০২২-২৩ অর্থবছর ডলারের মূল্যমান বৃদ্ধিতে ক্ষতি হয়েছে ৪২৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর পুরোটাই গেছে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে। ২০২১-২২ অর্থবছর এ খাতে ডেসকোর লোকসান ছিল মাত্র আট কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ কোম্পানিটির টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি এক বছরে প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ২০২০-২১ অর্থবছর ডেসকোর টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি ছিল না। বরং ওই অর্থবছর কোম্পানিটির এ খাতে ৩৩ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছিল।

ঢাকার দক্ষিণ অংশে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি)। এ কোম্পানিটি ২০২২-২৩ অর্থবছর ডলারের মূল্যমান বৃদ্ধিতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ৪১৪ কোটি ২৮ লাখ টাকার, যার পুরোটাই গেছে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর এ খাতে ডিপিডিসির লোকসান ছিল ৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে ডিপিডিসির ক্ষতি এক বছরে প্রায় ১৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ২০২০-২১ অর্থবছর কোম্পানিটির টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি হয়েছিল ১১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

এদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, বরিশাল ও বৃহত্তর ফরিদপুরের ২১টি জেলা ও ২০টি উপজেলায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব পালন করে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। এ কোম্পানিটি ২০২২-২৩ অর্থবছর ডলারের মূল্যমান বৃদ্ধিতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ৪২ কোটি ৯১ লাখ টাকার। এর পুরোটাই গেছে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে।

২০২১-২২ অর্থবছর এ খাতে ওজোপাডিকোর লোকসান ছিল ২৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়নজনিত কারণে কোম্পানিটির ক্ষতি এক বছরে প্রায় ৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছর কোম্পানিটির টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি হয়েছিল মাত্র ৮২ লাখ টাকা।

share biz