জয়নুল আবেদিনের ‘ভুয়া’ চিত্রকর্ম নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র!
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে জাতীয় জাদুঘরে আজ শনিবার প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। এতে যে ছবিগুলো দেখানো হয়, তার বেশির ভাগ ফেক (ভুয়া) ছবি বলে দাবি করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছেলে মইনুল আবেদিন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বাবার আঁকা নয়, এমন ছবি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানানো হয়েছে। এটা খুব দুঃখজনক। জাদুঘরের মতো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কাছে এমনটা কাম্য নয়।’ প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, ‘বাবা শিল্প চর্চার জন্য জীবনের পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন। দুঃখের বিষয় হলো, বাবার অনেক কাজ এখন নকল পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন জাদুঘরেও নকল ছবি দেখা গেছে। অথচ বাবার ছবি নকল হওয়া নিয়ে সংশ্লিষ্ট কারও মাথাব্যথা নেই। ভুয়া ছবি নিয়ে ঘটা করা নিলাম আয়োজন হওয়ার মতোও ঘটনা ঘটেছে!’
ভুয়া ছবি নিয়ে কেন প্রামাণ্য চিত্র বানালেন, প্রদর্শন করলেন? প্রশ্নটি করা হয় জাদুঘর কিপার (জনশিক্ষা) শিহাব শাহরিয়ারকে। তিনি সেমিনারে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। প্রথম আলোর জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নেট থেকেই ছবিগুলো নিয়েছি। ফেক ছবি আমরা চিনব কেমনে?’
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরকে ১৪ জন বরেণ্য ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালনের নির্দেশনা প্রদান করেছে বলে সেমিনারে জানালেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ। তার অংশ হিসেবে আজকের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন স্মরণে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন: শিল্পের শিক্ষাগুরু’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করা হয়।
সেমিনারে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন শিল্পসমালোচক অধ্যাপক মঈনুদ্দীন খালিদ। তিনি বলেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তথাকথিত জীবনের কাছে হার মানেননি। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জনজীবনের প্রতি ছিল তাঁর আকুল আবেদন। ছবি আঁকার আগে ছবির প্রেক্ষাপট মানুষের মর্মকথা বুঝতে চেষ্টা করতেন। তারপর তিনি ছবি আঁকতেন। তিনি বলতেন, নদীর ছবি আঁকার আগে পানির দোলনই আগে বুঝতে হবে।’
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন: শিল্পের শিক্ষাগুরু’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন অধ্যাপক মঈনুদ্দীন খালিদ। এ সময় জয়নুল আবেদিনের চিন্তাভাবনা, কর্ম আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আরও ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে বলে মন্তব্য করেন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সহকারী অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র গাইন। তাঁর লেখাটি পাঠ করেন জাদুঘরের কিপার শিহাব শাহরিয়ার। বক্তব্যের সূত্র ধরে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক ফরিদা জামান, শিল্পসমালোচক অধ্যাপক মঈনুদ্দীন খালিদ এবং শিল্পীপুত্র মইনুল আবেদিন। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান।
মূল প্রবন্ধটি শিল্পী দুলাল চন্দ্র গাইন লিখলেও ভাইয়ের অসুস্থতার কারণে তিনি সেমিনারে উপস্থিত থাকতে পারেননি। পাঠ করা সেই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একাধারে বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পথিকৃৎ, সফল শিল্পী-শিক্ষক, বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারক, বাহক ও সেবক এবং মানবতার প্রেমিক। শিল্পের টানে একান্ত নিজ প্রচেষ্টায় কলকাতায় গিয়ে সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং ছাত্র অবস্থাতেই তরুণ শিল্পী হিসেবে সারা বাংলায় সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার মাধ্যমে মানবতাবাদী শিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় একটি শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার নেতৃত্ব দান তাঁর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি চিত্রাঙ্কনের চেয়ে চিত্র শিক্ষা প্রসারের ওপর অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। চিত্রশিল্পবিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টার জন্য জনসাধারণ্যে তিনি শিল্পাচার্য অভিধা লাভ করেন।
বাবার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মইনুল আবেদিন বলেন, তিনি ব্যক্তি হিসেবে অনেক কর্মঠ একজন মানুষ ছিলেন। সারাক্ষণ কাজের ভেতরে ডুবে থাকতেন। শিল্পচর্চার জন্য জীবনের পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম নতুন প্রজন্মকে সৃজনশীল কাজে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ফরিদা জামান। তিনি বলেন, জয়নুল আবেদিন আমাদের নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের আদর্শ হিসেবে থাকবেন। তাঁর মতাদর্শ, চিন্তাশক্তি, ভাবনার ব্যাপ্তি তাঁর সৃষ্ট কর্মের মধ্যে তুলে ধরতেন।
সভাপতির বক্তব্যে শিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘পিতৃতুল্য শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের সান্নিধ্য পেয়ে আমার জীবন ধন্য। শিক্ষার্থীরা ছিল তাঁর ছেলের মতো। তাঁর কথায় ছিল প্রেরণা। আমরা অনুপ্রাণিত হতাম শিল্পচর্চায়। জাতীয় জাদুঘরে তাঁর অসংখ্য চিত্রকর্ম আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় ও সুস্থ মননসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবন, কর্মসহ দেশের অতীত ঐতিহ্য, চিত্রশিল্প গুরুত্ব বহন করে।’
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী। ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের তিনিই পুরোধা। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তাঁর নেতৃত্বের গুণে অন্যান্য শিল্পীদের সংগঠিত করার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তিনি এমন এক স্থানে এটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেখানে বাস্তবিক পক্ষে অতি নিকট অতীতেও শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাভিত্তিক কোনো ঐতিহ্য ছিল না। জয়নুল আবেদিন ও তাঁর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী সহকর্মীর অক্লান্ত চেষ্টায় মাত্র এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা তার স্থান করে নেয়। জয়নুল আবেদিনের অসাধারণ শিল্প-মানসিকতা ও কল্পনাশক্তির জন্য তিনি শিল্পাচার্য উপাধিতে ভূষিত হন।