today-is-a-good-day

জয়দেবপুর-বিমানবন্দর বিআরটি প্রকল্প দুর্ভোগ মাত্রা ছাড়া

The Daily Samakal

১৯ জুন ২০২১

রাজীব আহাম্মদ ও ইজাজ আহ্‌মেদ মিলন

বিআরটি প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে নির্মাণ করা হয়েছে হাই ক্যাপাসিটির ড্রেন। কিন্তু ড্রেনের মুখে ময়লা-আবর্জনা পূর্ণ থাকায় ঢুকতে পারছে না পানি। অল্প বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট-জনভোগান্তি। শুক্রবার টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকার ছবি- সমকাল

বিআরটি প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে নির্মাণ করা হয়েছে হাই ক্যাপাসিটির ড্রেন। কিন্তু ড্রেনের মুখে ময়লা-আবর্জনা পূর্ণ থাকায় ঢুকতে পারছে না পানি। অল্প বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট-জনভোগান্তি। শুক্রবার টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকার ছবি- সমকাল

যানজট নিরসনে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে রাজধানীর বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে বিশেষায়িত সড়ক। দ্রুত গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করার এ প্রকল্পের নাম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। ৯ বছর ধরে চলছে এর নির্মাণকাজ। যন্ত্রণা কমানোর প্রকল্পটির নির্মাণকাজে দায়িত্বহীনতা এখন মানুষের দুর্ভোগ বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আগে থেকেই সড়কে খানাখন্দ ছিল, এখন তা আরও বেড়েছে। বৃষ্টি হলেই সড়ক ডুবছে। ১২ কিলোমিটার পথ যেতে লাগছে ১০ ঘণ্টা।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), সেতু কর্তৃপক্ষ আর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর মিলে বিআরটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের সময় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ব্যয়ও বেড়েছে দ্বিগুণ। ৯ বছরে কাজ হয়েছে অর্ধেক। বাকি কাজ এক বছরে (আগামী জুন) শেষ করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।

সড়ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সমকালকে বলেছেন, বিআরটি বাস্তবায়নের করুণ দশা এবং তাতে চরম জনদুর্ভোগ তৈরি হওয়ায় মন্ত্রী ও সচিব বিব্রত। ধীরগতির কাজ ও ভোগান্তির জন্য চীনা ঠিকাদারদের দায়ী করছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্ভোগ এড়াতে নির্মাণ এলাকার রাস্তা নিয়মিত মেরামতের মাধ্যমে সচল রাখার কাজ করেনি। আগে থেকেই অবস্থা খারাপ ছিল। বর্ষায় পরিস্থিতি অসহনীয় হয়েছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল একই অভিযোগ করেছেন। সড়কের ভোগান্তি এড়াতে জয়দেবপুর-ঢাকা রুটে বিশেষ ট্রেন চালু করা হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

প্রকল্প সংশ্নিষ্টরা জানান, জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে ১২ কিলোমিটার করে মোট ২৪ কিলোমিটার ‘হাই ক্যাপাসিটি ড্রেন’ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে শতকোটি টাকা। সড়ক পরিবহন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ৩১ মে পর্যন্ত ড্রেনের নির্মাণকাজ ৯৭ ভাগ শেষ। ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও পানি নিস্কাশনের ক্ষমতা থাকার কথা ড্রেনটির। কিন্তু গত ১ জুন মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হয়। বৃষ্টির পানি ড্রেন দিয়ে মোগরখাল, হায়দারাবাদ খাল, কামারজুড়ি খাল হয়ে তুরাগ নদীতে মেশার কথা; কিন্তু বাস্তবে মহাসড়কে হাঁটুপানি জমে যাচ্ছে।

নতুন নির্মিত ড্রেনকে ত্রুটিপূর্ণ বলছেন গাজীপুর সিটি মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি সমকালকে বলেন, যতটা গভীর গর্তে পাইপ স্থাপন উচিত ছিল, তা হয়নি। পাইপের ব্যাসও মাত্র সাড়ে তিন ফুট। এই ব্যাসের পাইপ দিয়ে এত পানি যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে পানি উপচে সড়কে চলে আসছে। ভুল নকশায় হাই ক্যাপাসিটি ড্রেন নির্মাণ করে ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মকর্তারা টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

তবে বিআরটির সওজ অংশের প্রকল্প পরিচালক এএসএম ইলিয়াস শাহ দাবি করেছেন, শুধু ১ জুনই জলাবদ্ধতা হয়েছিল। ওই দিন পানি জমার কারণ ছিল, সড়ক থেকে ড্রেনে পানি নামতে ম্যানহোল ঢাকনার মতো যে ‘গ্যাসকিট’ ছিল, সেগুলো ময়লায় পূর্ণ ছিল। তাই পানি নামতে পারেনি। এখন আর পানি জমছে না। সড়কে খানাখন্দ রয়েছে। সেগুলো নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগে ঠিক করা কঠিন।

বৃহস্পতিবার বোর্ডবাজার, সাইনবোর্ড, চেরাগ আলী, গাজীপুরা, মালেকের বাড়ি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়ক নয় যেন সদ্য লাঙল দেওয়া ক্ষেত। খানাখন্দে ভরা। হেঁটে চলা দুস্কর। যানবাহন চলছে লাফিয়ে লাফিয়ে। যানজট কখনও কখনও এক দুই কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মহাসড়কের উভয় পাশের নর্দমা আবর্জনা জমে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। টঙ্গী বাজার এলাকায় রাস্তার খুবই খারাপ। ছোট-বড় গর্তের কারণে গাড়ি চলাচলই দুরূহ। একই অবস্থা দেখা গেছে স্টেশন রোড, কলেজ গেট, হোসেন মার্কেট ও গাছা এলাকায়।

এ সড়কের যাত্রী ও বাস মালিকরা বলছেন, শুধু একদিন নয়, বৃষ্টি হলেই পানি জমছে। রাস্তার অবস্থা এত খারাপ যে, যানজট না না থাকলেও ১০-১৫ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো যায় না। লোকসানে বাস বন্ধের চিন্তা করছেন বলে জানিয়েছেন মালিকরা।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক সামদানী খন্দকার বলেছেন, করোনার কারণে এমনিতেই অর্ধেক সিট খালি রাখতে হয়। যানজটের কারণে দিনে যদি একটি ট্রিপও না হয়, তাহলে মালিকরা চলবেন কী করে? উল্টো ভাঙা সড়কে বাস চালাতে গিয়ে যন্ত্রাংশ ভেঙে ক্ষতি আরও বাড়ছে।

ঢাকা-ময়মনসিংহ-শেরপুর সড়কে পত্রিকা পরিবহনকারী বাসের কর্মী শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ৭ জুন রাত সাড়ে ৯টায় তিনি গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে রওনা দিয়ে রাত ২টায় উত্তরা পৌঁছান। পত্রিকার গাড়ি সময়মতো আসতে পারছে না। সকালে পৌঁছাতেও পারছে না।

সাংবাদিক জাহিদুর রহমান জানান, বুধবার ঢাকা থেকে সকালে রওনা করে সাড়ে সাত ঘণ্টায় গাজীপুর পৌঁছেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এমন শত শত তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা যাত্রীরা জানাচ্ছেন।

হাউস বিল্ডিং থেকে চেরাগ আলী অংশে খারাপ অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন সড়ক পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আরবান ট্রান্সপোর্ট) নীলিমা আখতারও। তিনি সমকালকে বলেন, হাই ক্যাপাসিটি ড্রেন দিয়ে পানি নামার কথা খালে। সেখান থেকে যাবে নদীতে। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় মুগরখানে ড্রেনের পানি নামে। খাল ভরাট হয়ে আছে। পানি নামতে পারছে না। গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ করা হয়েছে, খাল প্রবহমান রাখার ব্যবস্থা নিতে।

জয়দেবপুর-টঙ্গী সড়ক করিডোর দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত সড়কগুলোর একটি। দৈনিক এ সড়কে গড়ে ৬০ হাজার যান চলাচল করে। উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলা এবং ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার গাড়ি চলাচল করে এ পথে। নীলিমা আখতার সমকালকে বলেন, এমন ব্যস্ত সড়কে নির্মাণকাজ চললে দুর্ভোগ এড়ানো কঠিন। বিকল্প সড়কও নেই। কী কী সমস্যা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করা হয়েছে। বুধবার গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কাদামাটি সরিয়ে খানাখন্দ ভরাট করে সড়কে যান চলাচলের জন্য উভয় দিকে দুই লেনের মতো জায়গা করা হচ্ছে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ঈদে যান চলাচল নির্বিঘ্ন রাখা। তবে ভারি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার শঙ্কা রয়েছে।

চারটি প্যাকেজে বিআরটির কাজ হচ্ছে। বাসের জন্য পৃথক লেন হচ্ছে সড়কের মাঝ বরাবর। ৮৫৫ কোটি টাকার এ কাজের ঠিকাদার চীনা প্রতিষ্ঠান গেজহুবা। বাকি তিন কিলোমিটার হবে ছয়টি পৃথক ফ্লাইওভারে। ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণ করছে সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। ৯৩৫ কোটি টাকার এ কাজের ঠিকাদার আরকে চীনা প্রতিষ্ঠান জিয়াংশু।

প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, নির্মাণকাজ চলাকালে সড়ক ব্যবহার উপযোগী রাখতে মেরামত করার শর্ত ছিল। কাজটি ঠিকাদারদের করার কথা। ঢাকায় চলমান মেট্রোরেল প্রকল্পেও নির্মাণ এলাকার সড়ক মেরামত ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু বিআরটি প্রকল্পে এ খাতে কোনো বিনিয়োগই করেনি চীনা ঠিকাদাররা। এ বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতার বলেন, ‘এখানে ঘাটতি রয়েছে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক সমকালকে বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য বড় শহরেরও ব্যস্ত রাস্তায় নির্মাণকাজ হয়। কিন্তু এমন অব্যবস্থাপনা থাকে না।

এ বিষয়ে নানাভাবে চেষ্টা করেও ঠিকাদারদের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।

প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ জানান, সব মিলিয়ে ৬০ শতাংশের মতো কাজ হয়েছে। তবে সড়ক পরিবহন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ মে পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার বিআরটি লেনের কাজ হয়েছে ৪৩ দশমিক ২০ শতাংশ। দুই হাজার ৮১২ মিটার দৈর্ঘ্যের ছয়টি ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ হয়েছে ৭১ শতাংশ। ১০ লেনের টঙ্গীর সেতুর কাজ হয়েছে প্রায় ৫৯ শতাংশ। ডিপো ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ।

২০১২ সালে কাগজে-কলমে শুরু হওয়া বিআরটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৩৯ কোটি টাকা। বাস্তবে ২০১৭ সালে যখন নির্মাণকাজ শুরু হয়, তখন নির্মাণ ব্যয় বেড়ে হয় চার হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালে কাজ শেষ হবে। পরে সময় আরেক দফা বাড়ে। পরিকল্পনা ছিল, জয়দেবপুর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত বিআরটি হবে। জয়দেবপুর-বিমানবন্দর অংশ নির্মাণে সীমাহীন দুর্ভোগের কারণে পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সরকার। বিমানবন্দর থেকে ঝিলমিল অংশে বিআরটি হচ্ছে না।