জোবায়দাদের আত্মহনন, ‘মানবিক’ সলিমুল্লাহ-কলিমুল্লাহরা কোথায়?

logo

যুক্তরাজ্য থেকে ডা: আলী জাহান

৫ ডিসেম্বর ২০২২, সোমবার

১. ঘটনাটি ঘটেছে ২০ নভেম্বর। ফলোআপ খবরের জন্য প্রায় ২ সপ্তাহ অপেক্ষা করলাম। একজন মানবিক সলিমুল্লাহ-কলিমুল্লাহ এগিয়ে আসেন কি-না তা দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। ‘সাদা মনের মানুষ’ বা ‘মানবিক সলিমুল্লাহরা’ এগিয়ে আসেননি। দেশ সিঙ্গাপুর বা কানাডার সমান হয়ে গেছে বলে যারা গলাবাজি করছিলেন (ইদানিং অবশ্য দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন) তাদের কোনো প্রতিনিধির (না রাজনৈতিক না সরকারি) কোনো ‘মানবিক নড়াচড়া’ দেখলাম না। এসব ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে স্বপ্রণোদিত হয়ে উচ্চ আদালত ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আদালতে ডেকে থাকেন। না, নোয়াখালীর এ ঘটনা উচ্চ আদালতের নজরে পড়েনি অথবা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, তাই কারো হাতে হ্যান্ডকাফ অথবা পায়ে ডান্ডাবেড়ি পড়েনি। আদালতের এসে জবাব দিতে হয়নি।

২. নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের একটি মাদ্রাসার দাখিল /১০ম শ্রেণির ছাত্রী জোবায়দা বাবার কাছে মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফি ও জুতা কেনার জন্য ৩ হাজার টাকা চেয়েছিল। সাত সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পিতা হাতিয়া কমিউনিটি কলেজের সামান্য বেতনে অফিস সহায়কের চাকরি করেন।

ইচ্ছে থাকলেও রফিক উদ্দিন মেয়েকে এই সামান্য টাকা দিতে পারেননি। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি মাদ্রাসায় চলে যায়। দুপুরে ফিরে আসে। এসেই বিষ পান করে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলেও জোবায়দাকে বাঁচানো যায়নি। মা-বাবাকে মুক্ত করে চিরদিনের জন্য সে অনন্তের পথে রওয়ানা দেয়।

৩. আমি জানিনা রফিক উদ্দিন এখন কেমন আছেন। তার স্ত্রী কেমন আছেন। জোবায়দার ভাইবোনগুলো কেমন আছে? যেহেতু মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে, তাই পরিবারের খবর নেয়ার জন্য কোনো সলিমুল্লাহ কলিমুল্লাহ এগিয়ে আসেননি। আসার কথাও না। সমাজটি সেভাবেই তৈরি হয়েছে। সে তো আর মুনিয়া না। তাই প্রেস ক্লাবে মুনিয়ার আত্মহত্যার বিচারের দাবিতে ‘মানবিক’ মানুষেরা কোনো মানববন্ধন বা সংবাদ সম্মেলন করেননি। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ‘ভদ্র লোকেরা’ জোবায়দার মৃত্যু নিয়ে কোনো প্রতিবেদন বা আলোচনা অনুষ্ঠান করার গরজ অনুভব করেননি।

৪. জোবায়দা কেন আত্মহত্যা করেছে? কারণ স্পষ্ট। নিষ্ঠুর দারিদ্র্য তাকে অভিমানী করে তুলেছিল। সামান্য ৩ হাজার টাকার জন্য সে আত্মহন করেছে। এ আত্মহত্যার দায়ভার নেবে কে?

৫. এই রাষ্ট্রকেই এই দায়ভার নেয়ার কথা। অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের গ্যারান্টিদাতারা কোথায়? উপজেলা প্রশাসন, সমাজ কল্যাণ বিভাগ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক- কাউকেই রফিক উদ্দিনকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসতে দেখলাম না।

কিন্তু কেন?

৬. কারণ বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা শাসকদের সব কাজের ইমিউনিটি দিয়েছে। সে কারণেই জোবায়দারা ১/২ হাজার টাকা দিয়ে পরীক্ষার ফি পরিশোধ না করার অভিমানে আত্মহত্যা করলেও তাদের কিছু হবে না। কিন্তু হবার কথা ছিল। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেব, উপজেলা সমাজ কল্যাণ বিভাগের কর্তা ব্যক্তি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং জেলা প্রশাসকের সবাইকেই এ মৃত্যু প্রতিরোধ না করার কারণে আদালতের মুখোমুখি হবার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এটা হবে না। বিশেষ করে মাদ্রাসাপড়ুয়া জোবায়দাদের অকাল মৃত্যু কারো জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। সে তো আর শিল্পপতির বান্ধবী বনানীর দামি দামি ফ্ল্যাটে থাকা কলেজ ছাত্রী মুনিয়া নয়।

৭. পরীক্ষার ফি, মাসিক বেতন এবং জুতা কেনার জন্য বাবার কাছে মাত্র ৩ হাজার টাকা না পেয়ে যেখানে একজন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, সেখানে ‘উন্নয়ন’ শব্দটি বড় বেমানান। যারা এই শব্দগুলো বারবার ব্যবহার করেন, তাদের চোখে কি রফিক উদ্দিনরা মানুষ নন? তাদের কান্না এবং হাহাকার কি রাষ্ট্র দেখতে পায় না? রাষ্ট্র শুধু মুনিয়ার জন্য কাঁদবে? জোবায়দাদের জন্য কাঁদবে না কেন?

ডা:আলী জাহান

কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য

সাবেক পুলিশ সার্জেন, যুক্তরাজ্য পুলিশ

alijahanbd@gmail.com