- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ১০ মার্চ ২০২১
মনীষী অস্টিন বলেন, ‘সার্বভৌম রাষ্ট্র নিঃসৃত আদেশই আইন।’ সঙ্গতভাবেই রাষ্ট্র তার নাগরিকদের শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়ন করে। সর্বযুগে সবকালে অবশেষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিকদের শাসকের জুলুম থেকে রক্ষা করার জন্য আইনের শাসনের কথা বলেছেন। আইনের শাসন মানে হলো- আইন হবে নৈর্ব্যক্তিক, সবার জন্য সমান ও শাসকের অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে। এ দেশেও কিছুকাল আগে এ কথাটি প্রচলিত ছিল যে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। এ কথার দ্বারা শাসকের অবস্থান যাই হোক না কেন ন্যায়ের ব্যতিক্রম হবে না- এ কথাই বোঝানো হয়েছে। এখন এ দেশে হুকুম নড়ে হাকিম বলবৎ থাকে। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে আইনের শাসনের অগ্রগতি সুদৃঢ় হওয়ার কথা। পশ্চিমা বিশ্বে আইনের শাসন সংবিধান ও বিচারব্যবস্থা দ্বারা অনেকটাই বাস্তব। কিন্তু প্রাচ্যে বা তৃতীয় বিশ্বে আইনের স্বেচ্ছাচার, যথেচ্ছাচার ও ব্যক্তিগত প্রয়োগ এতটাই বেড়েছে যে, নাগরিক স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্নে হয়ে পড়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের অবস্থান ‘রাজা বাদী উত্তর না দি’। নামকাওয়াস্তে গণতন্ত্রের দেশে জনগণ উত্তর না দিয়েও তার অবস্থান নিশ্চিত করতে পারছে না। এসব দেশে আইনই প্রণয়ন করা হয় বেআইনি কাজ করার জন্য। ‘এখানে লিখিত আইনগুলো মাকড়সার জালের মতো। এর দ্বারা গরিব ও কমজোরকে ধরে রাখা যায়। (বাস্তব মামলাগুলোর প্রমাণ দেখুন) ধনী শক্তিমান সহজেই তা ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারে।’ অনেক সময় খোদ সংবিধানে এমন সব সংযোজন লক্ষ করা যায় যা নাগরিক সাধারণের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। একেকজন ব্যক্তি, একেকটা গোষ্ঠী বা দল তাদের স্ব স্বার্থে আইন প্রণয়ন করে। এ দেশে এই সময়ে আইনের ছড়াছড়ি।
বাংলাদেশের একজন প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী আনু মোহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা একই সঙ্গে দু’টি শাসন দেখতে পাচ্ছি। একটি হচ্ছে, আইনবহির্ভূত জুলুম, অন্যটি আইন জারি করে জুলুম। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে সেই জুলুমের আইন।’
১৯৭৫ সালের পর ২১ বছর পেরিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে যখন তারা ক্ষমতায় আবার ফিরে আসে তখন মানুষ আশা করেছিল, তারা অতীত থেকে শিক্ষা নেবে। গণতন্ত্র ফিরে আসবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তারা তা না করে তাদের অভ্যাসমতো বিপরীতটিই করেছে। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার উদাহরণটি দেখলেন। এবার তারা কারণে অকারণে নিপীড়নমূলক অধ্যাদেশের পর অধ্যাদেশ জারি করে জনজীবন বিষিয়ে দিয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রথম করা হয় ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে পরবর্তী নির্বাচনের পূর্বক্ষণে শাস্তি বাড়িয়ে আইনটিকে আরো কঠোর করা হয়। আইনটি ঘোষণার পর সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। এই বিরোধিতাকে প্রতারণার মাধ্যমে মোকাবেলা করে তারা। ২০১৩ সালের আইনের ৫৭ ধারায় অপরাধের ধরনগুলো একসাথে উল্লেখ ছিল। ২০১৮ সালের আইনে শুধু সেগুলো বিভিন্ন ধারায় ভাগ করে দেয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬সহ মোট ৫টি ধারা বিলুপ্ত করে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পাস করা হয়। এ আইনটিতে পূর্বেকার আইনের পরিবর্তন না করায় আবারো গণপ্রতিক্রিয়া তীব্র হয়ে ওঠে। ৩২ ধারায় সাংবাদিকদের হয়রানির বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবাদ উত্থিত হয়। এর কয়েকটি আলোচিত সমালোচিত ধারা এ রকম : ১৭ ধারা অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় বেআইনি প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন, বিনষ্ট বা অকার্যকরের চেষ্টা করে তাহলে অনধিক সাত বছরের জেল, জরিমানা ২৫ লাখ টাকা। ক্ষতিসাধন করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড। জরিমানা এক কোটি টাকা। ১৮ ধারা অনুযায়ী ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে বেআইনি প্রবেশ বা সহায়তা করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড। জরিমানা ২০ লাখ টাকা। ১৯ ধারা অনুযায়ী বেআইনিভাবে যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম হতে কোনো উপাত্ত, উপাত্তভাণ্ডার, তথ্য বা উদ্ধৃতাংশ সংগ্রহ করেন বা কোনো উপাত্তের অনুলিপি সংগ্রহ করেন তাহলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা ১০ লাখ টাকা। ২০ ধারা অনুযায়ী কম্পিউটার সোর্স কোড পরিবর্তন, ধ্বংস করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের সাজা, জরিমানা তিন লাখ টাকা। ২১ ধারা অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রপাগান্ডা ও প্রচার চালানো বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকার জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এভাবে ৬২ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত এই আইনে এমন কোনো বিষয় বাদ রাখা হয়নি যা সমাজ ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করে না। অর্থাৎ যেকোনো অজুহাতে যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো সময়ে যাতে আটক বা গ্রেফতার করা যায় তার বিধান এতে রয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে প্রচারিত বা প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সেগুলি ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা-বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেফতার করতে পারবে। এই আইনে ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক সময়ে অনুসৃত অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট কায়দা করে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনো সরকারি আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয় বা প্রকাশ করে বা করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে ১৪ বছরের সাজা হতে পারে। ২৫ লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এই আইনে প্রকারান্তে গুপ্তচরবৃত্তি আইনও প্রকারান্তরে বিধিবদ্ধ হয়েছে। অনুরূপ কার্যক্রমকে গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য করা হবে এই জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। এই আইনে ফেসবুকে মানহানিকর বা অবমাননাকর বক্তব্যের জন্য আইনি ব্যবস্থার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের বা বিশে^র যে কোনো দেশে বসে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন তাহলেও এই আইনে বিচার করা যাবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবস পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো যাবে। নতুন আইনের বেশির ভাগ ধারাই জামিন অযোগ্য। তবে মানহানির ২৯ ধারাসহ কয়েকটি ধারায় জামিনের বিধান আছে। এই আইনটি সামরিক শাসন আমলে ঘোষিত আকারে ইঙ্গিতে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরোধিতার ধারাগুলো মনে করিয়ে দেয়।
জামিনের বিধান থাকলেও বিচারের ভার তো তাদেরই কাছে। সুতরাং জামিন পাওয়া না পাওয়া তাদের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। জামিন যে তাদের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল কারাগারে মুশতাকের মৃত্যুবরণ তার প্রমাণ। সব বিশ্লেষণে এসেছে যে, কার্টুনিস্ট কিশোরের মুক্তি সম্ভব হতো না যদি মুশতাকের মৃত্যু না ঘটত। মুশতাকের মৃত্যুকে দেশের বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করেছেন। সারা দেশে ডান-বাম ও সিভিল সোসাইটি সব পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। রাজপথ উত্তাল হয়েছে মিছিলে মিছিলে। প্রেস ক্লাব, শাহবাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকেও দমন-পীড়নের মাধ্যমে অবদমিত করার চেষ্টা চলছে। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনহুলো এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে। সবার বক্তব্য, একই কথা নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, আপত্তিকর অংশ সংশোধন করা হবে। আগের মতোই এটি সরকারের প্রতারণা কৌশল মনে করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। সম্পাদক পরিষদ পুনর্বার তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে বলেছে, আইনটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আশঙ্কার চেয়েও কঠিনভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আইনটি পাস করার পর থেকে দেখা যায় সরকারি দলের সংসদ সদস্য, নেতানেত্রীরা, সরকারের মন্ত্রীরা এ আইনকে তাদের দুর্নীতি ও দুরাচার ঢেকে রাখার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মিডিয়া ওয়াচডগ বিডি ‘আর্টিকল-১৯’ এর তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় বাংলাদেশের ৪৫৭ জনকে বিচার আওতায় আনা হয়েছে ও গ্রেফতার করা হয়েছে। এই আইনের অপপ্রয়োগে এই মুহূর্তে একজন প্রবীণ সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতা জেলে অন্তরীণ রয়েছেন।
আমরা আগেই বলেছি, আইনের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের সুরক্ষা দেয়া। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খোলসে বিরোধী তথা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিগ্রহ ও নির্মূলে আইনটির যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ভিন্ন মতাবলম্বীদের স্তব্ধ করার খড়গ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জুলুমের এই আইনের অবসান ঘটাতে হবে অনতিবিলম্বে। ‘রেখে দাও তব আপনার রচা আইন কানুন তাকে, ভঙ্গুর যে তাহা, যদি সে আইনের ধর্ম নাহি থাকে।’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]