ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ১২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছিল জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও কর্মসংস্থান, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবার মতো কাজের জন্য এ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার দুই মাসে এই ফাউন্ডেশন এখনো আর্থিক সহায়তা-কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি। এখনো হতাহত ব্যক্তিদের তথ্য যাচাইয়ের সঙ্গে চলছে সহায়তা।
নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ লাখ ও আহত ব্যক্তিদের এক লাখ টাকা করে অনুদান দিচ্ছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক নিহত ব্যক্তির পরিবার এবং পাঁচ শতাধিক আহত ব্যক্তিকে গড়ে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক এই সহায়তা কার্যক্রম শেষ হবে বলে আশা করছেন ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা।
গত ২৮ অক্টোবর অফিস আদেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীন ‘গণ–অভ্যুত্থান–সংক্রান্ত বিশেষ সেল’ গঠন করার কথা জানায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেলের প্রধান একজন অতিরিক্ত সচিব। সেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চার কর্মকর্তার পাশাপাশি চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি এবং দুজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রয়েছেন। এই সেলের সঙ্গেও কাজ করছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন সরকার অনুমোদিত একটি অরাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবা ও জনকল্যাণমূলক বেসরকারি সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ফাউন্ডেশনের সাত সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সভাপতির দায়িত্বে আছেন। সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন আন্দোলনে নিহত মীর মাহফুজুর রহমানের (মুগ্ধ) ভাই মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ)।
জরুরি আর্থিক সহায়তা শুরু করার জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর ফাউন্ডেশনে ১০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ফাউন্ডেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ টাকা এবং প্রত্যেক আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে।
২১ সেপ্টেম্বর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সহায়তা কার্যক্রমের সূচনা হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সিএমএইচে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে উপহার দেওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৩ অক্টোবর অভ্যুত্থানে হতাহত ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহের জন্য হটলাইন নম্বর (১৬০০০) এবং ফাউন্ডেশন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য ওয়েবসাইট (www.jssfbd.com) চালু করা হয়। হটলাইন নম্বরে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যোগাযোগ করা যায়। গত মাসের শেষাংশ থেকে হটলাইন নম্বর থেকে ফোন করে হতাহত ব্যক্তিদের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
যেভাবে কাজ করছে ফাউন্ডেশন
২৪ অক্টোবর শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দক্ষিণে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএসএল অফিস কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যালয় নেওয়ার কথা জানানো হয়। বারডেম হাসপাতাল ও ইন্টারকন্টিনেন্টালের মধ্যবর্তী অংশে কার্যালয়টি অবস্থিত। ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের কার্যালয়টিতে ২০ জনের মতো কর্মচারী রয়েছেন। কয়েকটি দল করে এখানে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এগুলো হলো ভেরিফিকেশন (যাচাই) টিম, হেল্প সেন্টার (সহায়তা কেন্দ্র) ও অ্যাকাউন্টস (হিসাব) টিম। এ ছাড়া কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একজন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক আছেন।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তিনটি উইংয়ে কাজ করছে। একটি উইং ‘শহীদ পরিবারের পাশে বাংলাদেশ’ শিরোনামে শহীদ পরিবারকে সহায়তার কাজ করছে। দ্বিতীয়টি কাজ করছে আহত ব্যক্তিদের নিয়ে। আর আরেকটি জরুরি বা কুইক রেসপন্স টিম রয়েছে। কার্যালয় নেওয়া, সেখানে আসবাব সাজানো এবং জনবল নিয়োগের পর টিম ভাগ করে তারা কাজ শুরু করেছে চলতি মাসের প্রথম থেকে। সেই হিসাবে তাদের সংগঠিতভাবে কাজ শুরু করার দুই সপ্তাহ হয়েছে।
ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোলাবরেট (সমন্বয়) করছি। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে নতুন একটা সেল খোলা হয়েছে। সেটার সঙ্গেও আমাদের একটা কোলাবরেশন আছে। সেলের পক্ষ থেকে আহত ও শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন, গুরুতর আহত ব্যক্তিদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠাতে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
এখন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে যে আর্থিক সহযোগিতা করা হচ্ছে, এটি একেবারেই প্রাথমিক সহযোগিতা বলে জানান সারজিস। তিনি বলেন, ‘আমাদের জায়গা থেকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা অবশ্যই আছে। প্রতিটি শহীদ পরিবার ও গুরুতর আহত ব্যক্তিদের পরিবারের যেকোনো একজনের চাকরির ব্যবস্থা করার চিন্তা আমাদের আছে। আমাদের যে ভাইয়েরা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বা অঙ্গ হারিয়েছেন, সেই অঙ্গ প্রতিস্থাপনে কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ব্যবস্থা করার চিন্তা আছে। এ ছাড়া সম্মানী ভাতার ব্যবস্থা করার বিষয়েও আলোচনা চলছে।’
সময় লাগছে যাচাইয়ে
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ভালোভাবে যাচাইয়ের পর তালিকা তৈরি করে আর্থিক সহায়তা করছে। যাচাই–প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে দৈনিক ৫০০ জনকে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন ফাউন্ডেশন–সংশ্লিষ্টরা। এখন যাচাইয়ের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তাও চলমান রয়েছে। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, তাদের তালিকায় প্রশ্নবিদ্ধ কেউ ঢুকুক, তা তারা চায় না।
যাচাইয়ে সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তির কাগজ, ছাড়পত্র, ব্যবস্থাপত্র ইত্যাদি যাচাই করতে সময় লাগছে। অনেকের কাছে এগুলো নেই।
রোগীদের সব কাগজপত্র যাচাই করা, যে হাসপাতালে তিনি ছিলেন সেখানে যাচাই করা, জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে যাচাই করা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমআইএসে তাঁর ডেটা আছে কি না, তা যাচাই করা—এই প্রক্রিয়াগুলোর মাধ্যমে যাচাই করতে কিছুটা সময় লাগছে বলে জানান সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘তবে এখন একদিকে ভেরিফিকেশন (যাচাই), অন্যদিকে পেমেন্ট (অর্থ দেওয়া) চলছে। এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক শহীদ পরিবার ও পাঁচ শতাধিক আহতকে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। একবার যদি আমরা গুছিয়ে নিতে পারি, তাহলে কাজ করা খুব সহজ হবে। আমরা আশা করছি, নভেম্বরের মধ্যে অধিকাংশ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে সবার হাতে আমাদের আর্থিক সহযোগিতা পৌঁছে যাবে।’
কেউ যেন কোনোদিন এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে, সে জন্য একটু সময় নিয়ে যাচাই করা হচ্ছে উল্লেখ করে সারজিস আলম বলেন, ‘তার পরও যাঁরা জরুরি সহায়তার জন্য আসছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে ম্যানেজ করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি যাঁদের জরুরি সহায়তা লাগবে, তাঁদের তালিকা দিতে বলেছেন। তাঁরা প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার টাকা করে সহযোগিতা করবেন।’
prothom alo