
রাজনৈতিক পুনর্গঠনের স্বপ্নে জুলাই বিপ্লবকে ‘ইতিহাস সংশোধনের সূচনা’ হিসেবে দেখছেন দেশের প্রভাবশালী আলেম সমাজ। তাদের মতে, রাষ্ট্র গঠনের প্রতিটি ধাপে যাদের অবদান অনস্বীকার্য, সেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও আলেমদের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে ঘোষণা ও সংবিধানে।
শনিবার (৩১ মে) বিকেলে ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ) আয়োজিত আলোচনা সভা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র : মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও আলেম সমাজের ভাবনা’ শীর্ষক আয়োজনে এমন মত দেন আলেম সমাজের নেতারা। এটি জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিষয়ক ধারাবাহিক সংলাপের তৃতীয় পর্ব।
সংলাপে প্রধান আলোচক রাষ্ট্রচিন্তক ও আলেম মুসা আল হাফিজ বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র কেবল একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এটি হচ্ছে একবিংশ শতকের বাঙালি মুসলমানদের রাষ্ট্রচিন্তার পুনর্জন্ম। এখানে আমরা এমন একটি রাষ্ট্রের কথা বলছি, যা সেক্যুলার প্রকল্পের বাইরের– মানবিক, ইনসাফভিত্তিক, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারা চালিত। আমাদের দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা এসেছে এই মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতির কারণে।
তিনি বলেন, নতুন রাষ্ট্রকাঠামোতে থাকতে হবে বিকেন্দ্রীকরণ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার, দলীয়করণ মুক্ত প্রশাসন এবং নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এটি সম্ভব যদি আমরা আলেম সমাজের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও চিন্তাকে রাষ্ট্রচর্চার অংশ করি।
‘আলেমরা ট্যাক্স দেন কিন্তু রাষ্ট্র থেকে ন্যায্য কিছুই পান না’
আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, আমাদের রাষ্ট্রে দীর্ঘকাল ধরে ধর্মীয় শিক্ষা ও আলেম সমাজকে এক ধরনের পেছনের সারির মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতোই আলেম সমাজও ট্যাক্স দেন কিন্তু নাগরিক সুবিধায় তাদের অবস্থান সবচেয়ে নিচে।
তিনি বলেন, এ বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। জুলাই ঘোষণাপত্রে এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামোর কথা থাকতে হবে, যেখানে আলেম-মুফতিদের কণ্ঠস্বর থাকবে স্পষ্ট, মর্যাদাপূর্ণ। আমরা চাই এ ঘোষণাপত্র সংবিধানে প্রতিফলিত হোক, যেখানে নতুন বাংলাদেশ হবে ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ মুক্ত। প্রতিটি নাগরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে সেখানে।
‘আলেমদের বাদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্র টিকে না’
হেফাজতে ইসলাম যাত্রাবাড়ী থানার সিনিয়র সহ সভাপতি ছাকিবুল ইসলাম কাসেমি বলেন, ইতিহাসে একের পর এক প্রমাণ হয়েছে, আলেম সমাজ ও মাদ্রাসা ছাত্ররা এ দেশের তাহাজ্জিব-তমদ্দুন রক্ষায় প্রাণ দিয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, দমন-নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সেই অবদানকে কখনো স্বীকার করেনি। বরং কৌশলে ইতিহাস থেকে তাদের মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করি, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে এ ভুল ইতিহাস সংশোধন শুরু হবে। যারা রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখেছেন, তাদের নাম যেন আর মুছে না যায়। জুলাই ঘোষণাপত্র সেই সত্য ভাষণের জায়গা হোক।
‘ঘোষণাপত্রে আলেমদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে’
তরুণ চিন্তক ও মাদ্রাসা গবেষক ইফতেখার জামিল বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ঘোষণা দেখি, প্রস্তাব দেখি কিন্তু কোথাও আলেম সমাজের অবস্থান নির্দিষ্ট করা থাকে না। এবার ভিন্ন কিছু চাই। জুলাই ঘোষণাপত্রে আলেমদের অবস্থান, দাবিদাওয়া, প্রত্যাশা সবকিছু সুস্পষ্টভাবে থাকা উচিত।
তিনি বলেন, প্রতিটি সেক্টরে– চাকরি, শিক্ষা, প্রশাসন, পররাষ্ট্রনীতি– সব জায়গায় আলেম সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যেন তারা কেবল মসজিদের মিম্বরে নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও ভূমিকা রাখতে পারেন।
‘শাপলার গণহত্যা ও চব্বিশের আত্মত্যাগকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে’
বক্তারা আরও বলেন, ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে আলেমদের ওপর ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা চালানো হয়। কোনো বিচার হয়নি। বরং সেসব আলেমকে আজও ট্যাগিং-ফ্রেমিংয়ের শিকার হতে হয়। চব্বিশ সালের গণঅভ্যুত্থানে মাদ্রাসা ছাত্রদের সাহসী ভূমিকা এক অনন্য ইতিহাস– এই আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিতে হবে রাষ্ট্রকে।
তারা বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে যদি ইনসাফ, দমনপীড়নের প্রতিকার এবং সংবিধানে বিপ্লবের স্বীকৃতি না আসে, তাহলে আবারও ইতিহাস বিকৃতির পথেই যাব আমরা।
সভায় বক্তব্য দেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মীর ইদরীস, আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য রিদওয়ান হাসান ও মুত্তাকী বিন মনির, তানযীমুল উম্মাহ যাত্রাবাড়ী শাখার প্রিন্সিপাল মাসউদুর রহমান, মুফতি মাছুম বিল্লাহ মাহমুদী, মাকছুদুর রহমান জুনায়েদ, ইউসুফ আহমাদ, আবরার কাউসার প্রমুখ।
সভার সঞ্চালনা করেন যাত্রাবাড়ীর সংগঠক ফাইজুল্লাহ মাহমুদ।