- সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
- ২৫ জানুয়ারি ২০২২
দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও তারিখ
বিগত ১৯ জানুয়ারি ২০২২ ছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মদিন। আমার অবসর জীবনে লেখালেখি যতদিন করি, ততদিনই যথাসম্ভব উপযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক সময়ে জিয়াউর রহমান সম্বন্ধে লিখেছি এবং যখন বলার কথা, তখন বলেছি। ১৩ জানুয়ারি ২০২২-এর অপরাহ্ণের অনলাইন পত্রিকাগুলোতে একটি সংবাদ পাওয়া যাবে, যেটি পূর্ণাঙ্গ আকারে ছবিসহ পরের দিনের তথা ১৪ জানুয়ারি ২০২২-এর মুদ্রিত সংস্করণেও আছে। সংবাদটি হলো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীতকালীন বহিরাঙ্গন অনুশীলন সমাপ্ত। সাবেক সৈনিক ও বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মী সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের জন্য ওই সংবাদটি ছিল অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক ও উৎসাহব্যঞ্জক। বিস্তারিত কথা নিচে একটি অনুচ্ছেদে আছে। ওই সংবাদটি পড়তে পড়তেই জিয়াউর রহমান ও ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা মনে এসে গেল। ভাবছিলাম লিখব; কিন্তু শরীরটা যৎকিঞ্চিৎ খারাপ হয়ে পড়ায় সময়মতো আর লেখা হয়ে ওঠেনি।
১৯ জানুয়ারি ২০২২ তারিখের পত্রিকাগুলো পড়ে, বিশেষত নয়া দিগন্ত পত্রিকা পড়ে নিজের ভেতরে তাগাদা অনুভব করলাম, বীর উত্তম জিয়াউর রহমানকে নিয়ে দু-চারটি অনুচ্ছেদ অবশ্যই লেখা প্রয়োজন। ওই দিন (১৯ জানুয়ারি ২০২২) পত্রিকাটির পঞ্চম পৃষ্ঠায়, এক পৃষ্ঠাব্যাপী একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে, বিএনপির উদ্যোগে বা পৃষ্ঠপোষকতায়। ওই ক্রোড়পত্রে মোট তিনটি রচনা বা বক্তব্য আছে। প্রথমে আছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাণী। দ্বিতীয়ত আছে অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডি কর্তৃক লিখিত কলাম। যার শিরোনাম : ‘বাংলাদেশে কৃষির রূপান্তর এবং প্রেসিডেন্ট জিয়া’। তৃতীয়ত আছে ‘জাতীয়তাবাদী জিয়া’ নামে একটি কলাম, যার লেখক হচ্ছেন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শ্রদ্ধাভাজন মরহুম অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। কৃষি ও প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রসঙ্গে পড়তে গিয়ে মনে এলো সামরিক বাহিনী ও প্রেসিডেন্ট জিয়া বা দেশের প্রতিরক্ষা ও প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রসঙ্গে অবশ্যই আমার লেখা উচিত।
সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন : অনুশীলন নবদিগন্ত
এ বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চার সপ্তাহব্যাপী শীতকালীন প্রশিক্ষণ শেষ করেছে ১৩ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে। চূড়ান্ত অনুশীলনের নাম ছিল ‘অনুশীলন নবদিগন্ত’ (ইংরেজি ভাষায় : এক্সসারসাইজ নবদিগন্ত)। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশন (তথা সাভার এরিয়া) সফলভাবে এই অনুশীলন পরিচালনা করে। চূড়ান্ত দিনের অনুশীলনে সাঁজোয়া বহর (অর্থাৎ ট্যাংক বাহিনী), এপিসি (অর্থাৎ পদাতিক বাহিনীর সৈন্য বহনকারী আরমার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার), এমএলআরএস বা মাল্টিপল-লঞ্চড-রকেট-সিস্টেম (অর্থাৎ একই সাথে একই কামান-পুঞ্জি থেকে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার বিশেষায়িত আর্টিলারি গোলা), সেনাবাহিনীর ছত্রিসেনা (অর্থাৎ প্যারাসুটের সাহায্যে নেমে আসা কমান্ডো বাহিনী), বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কিছুসংখ্যক জঙ্গিবিমান অংশগ্রহণ করে। এ বছরের শীতকালীন প্রশিক্ষণের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো লজিস্টিকস ফিল্ড ট্রেনিং এক্সারসাইজ পরিচালনা করে। সেনাবাহিনীর লজিস্টিকস স্থাপনাগুলো বহিরাঙ্গনে মোতায়েন হয়েছিল। বাংলাদেশের ভূমিতে যখন যুদ্ধ হবে, তখন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী অবশ্যই যুদ্ধ করবে।
যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে। একটি ক্যাটাগরি হলো লজিস্টিকস সাপোর্ট প্রদানকারী বাহিনী। যথা : রেশন সরবরাহ, গোলাবারুদ সরবরাহ, অসুস্থদেরকে নিরাপদ অঞ্চলে আহরণ করে আনা, ক্ষতিগ্রস্ত বা অচল হয়ে যাওয়া গাড়িঘোড়া রিপেয়ার করা ইত্যাদি কাজ যুদ্ধ চলাকালীন বহু গুণ বেশি গুরুত্ব অর্জন করে। বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে যথা যশোরের চৌগাছা বা বৃহত্তর কুষ্টিয়ার মেহেরপুর বা রাজশাহী সীমান্ত বা বৃহত্তর রংপুরের রৌমারী সীমান্ত বা বৃহত্তর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত বা বৃহত্তর সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত বা বৃহত্তর কুমিল্লার আখাউড়া সীমান্ত ইত্যাদি এলাকায় যখন যুদ্ধ হয় তখন ঢাকা-সাভার-রাজেন্দ্রপুর-গাজীপুর এই পুরো অঞ্চলটিকে যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বলা যায়। কিন্তু যুদ্ধ যদি বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলে আসে (যেমন কিনা ১৯৭১ সালে হয়েছিল) তাহলে ঢাকাকে কেন্দ্রে অবস্থিত বলা যাবে না। অতএব ওই রকম একটা পরিস্থিতিতে লজিস্টিকস স্থাপনাগুলো কী নিয়মে যুদ্ধরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেবে, এটার কার্যকর পদ্ধতি নির্ধারণ করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। শান্তিকালীন লজিস্টিকস স্থাপনাগুলো ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই থাকে কারণ স্থাপনাগুলো বৃহদাকৃতির হয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত না হলে সেনাবাহিনীকে উপযুক্ত সেবা দেয়া যায় না। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন সেনানিবাসগুলো কতটুকু সুরক্ষিত থাকবে এবং সেনানিবাসে থেকেই দূরবর্তী অঞ্চলে যুদ্ধরত সৈন্যদেরকে এইরূপ লজিস্টিকস সাপোর্ট কতটুকু দেয়া যাবে এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করে প্রথমবারের মতো অনুশীলন করেছেন অর্থাৎ লজিস্টিক স্থাপনাগুলোকেও সেনানিবাসের বাইরে গিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি বা পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এই প্রথমবার উদ্যোগ নেয়া হলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।
তিন বাহিনীর জন্য সমন্বয় দফতর
তিন বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে সমন্বয় করার জন্য প্রথমে কমান্ডার ইন চিফস সেক্রেটারিয়েট সৃষ্টি করা হয়েছিল জেনারেল জিয়ার আমলে। তিন বছর পর এটার নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছিল সুপ্রিম কমান্ড হেডকোয়ার্টার্স। ওই দফতরটিই পরিমার্জিত হয়ে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ বা আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন। যিনি এই বিভাগ বা ডিভিশনের প্রধান, তিনি মেজর জেনারেল অথবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এবং তাকে বলা হয়, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার। সেই ১৯৮১ সালে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী বীর উত্তম।
সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক আকৃতি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম বা কার্যকর জন্ম আনুষ্ঠানিকভাবে বলা যায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম প্রহরে। যুদ্ধের চতুর্থ মাসে এসে ‘জেড ফোর্স’ নামক ব্রিগেড সমতুল্য সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে যুদ্ধকালীন আর্মির নবজন্ম হয়েছিল। পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে ‘এস ফোর্স’ এবং ‘কে ফোর্স’ নামক সংগঠন কাজ শুরু করে। প্রায় একই সময়ে নবম ইস্ট বেঙ্গল, দশম ইস্ট বেঙ্গল এবং এগারো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জন্ম নেয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রথম দিন। প্রথম দুই মাসের মধ্যেই ঢাকা, কুমিল্লা, রংপুর, যশোর ও চট্টগ্রামে একটি করে পদাতিক ব্রিগেড সংগঠিত করা হয়। পরবর্তী দুই বছরে আরো ব্রিগেডের জন্ম হয় এবং সেনাবাহিনী বিকশিত হয়। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের ৭ তারিখের পরে যখন জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাঁধে বাংলাদেশের দায়িত্ব এসে পড়ে, তখন তিনি সেনাবাহিনীতে আকৃতিগত মৌলিক পরিবর্তন আনেন। ঢাকা মহানগরের শেরেবাংলা নগরে ৯ পদাতিক ডিভিশন সংগঠিত করার মাধ্যমে, সেনাবাহিনীতে ফিল্ড ফরমেশন হিসেবে ডিভিশন-তত্ত্বের যাত্রা শুরু করা হয়।
এরকমভাবে বগুড়া, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম ইত্যাদি সেনানিবাসেও ডিভিশন সংগঠন করা হয়। এইরূপভাবে চলার পঞ্চম বছরের শেষে, এক্সসারসাইজ আয়রন শিল্ড আয়োজন করা হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, তৎকালীন বিডিআর ছিল পাকিস্তান আমলের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস নামক সংগঠনের আদলে গড়া। আনসার এবং ভিডিপি সংগঠনটি ছিল জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেমিক চিন্তার ফসল। গ্রামগঞ্জে যেন একদল তরুণ সর্বদাই থাকে, যারা দেশকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিরক্ষাবাহিনীর পাশে দাঁড়াতে পারবে, মানুষকে সাহস জোগাতে পারবে, মানুষকে সংগঠিত করতে পারবে এবং একই তরুণগুলো শান্তিকালীন সময়ে উৎপাদনমুখী উন্নয়নমূলক স্থানীয় কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেবে। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার পর তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতোই, এক্সসারসাইজ আয়রন শিল্ডের মাধ্যমে, অনুশীলনের প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়েছিল।
জিয়াউর রহমান ও এক্সসারসাইজ আয়রন শিল্ড
আজ থেকে ঠিক ৪০ বছর আগে, ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো একটি বৃহদাকৃতির ও সমগ্র সেনাবাহিনীর সম্মিলিত অংশগ্রহণে যুগপৎ আংশিকভাবে কমান্ড পোস্ট এক্সসারসাইজ, আংশিকভাবে ফিল্ড ট্রেনিং এক্সসারসাইজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে, ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, তৎকালীন মিরপুর সেনানিবাসে অবস্থিত ‘ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ’-এর কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে দু’জন ব্রিগেডিয়ার ও তিনজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোট ছয়জনের একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করেছিল। সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, একাধিক বাহিনীর সমন্বয়ে চীনা অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। ঘটনাক্রমে আমি ওই সময়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদায় সেনাবাহিনী সদর দফতরের সামরিক প্রশিক্ষণ পরিদফতর বা মিলিটারি ট্রেনিং ডাইরেক্টরেইটের একজন জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-১ বা জিএসও-১ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলাম। চীন সফরকারী প্রতিনিধিদলে আমিও শামিল ছিলাম।
ওই আমলের কমান্ডার ইন চিফস সেক্রেটারিয়েটের আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনায় ও পরিচালনায়, মিরপুর সেনানিবাসে অবস্থিত ‘ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ’ এর পরিকল্পনা-সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরের সামরিক প্রশিক্ষণ পরিদফতরের সর্বাঙ্গীণ পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে যেই অনুশীলনটি বা এক্সসারসাইজটি অভ্যাস করা হয়েছিল সেটির নাম ছিল ‘এক্সসারসাইজ আয়রন শিল্ড’। নামটি পছন্দ করে দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। নামটির বাংলা অর্থ দাঁড়ায় অনুশীলন লৌহ বর্ম। আমি যেহেতু সেনা সদরের সামরিক প্রশিক্ষণ পরিদফতরেই নিয়োজিত একজন স্টাফ অফিসার ছিলাম, অতএব অপরিহার্যভাবেই এক্সসারসাইজ আয়রন শিল্ড এর সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতির সাথে জড়িত ছিলাম। আমি যুগপৎ একজন পরিশ্রমী কর্মী ছিলাম এবং পদে পদে আবার নিজেও শিখছিলাম। সেই এক্সসারসাইজ আয়রন শিল্ড-এর লক্ষ্যবস্তু এবং উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফিল্ড ফরমেশনগুলোকে সমন্বিতভাবে চিন্তা করতে সুযোগ দেয়া। ওই এক্সসারসাইজের আরেকটি লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতিতে, বাংলাদেশ রাইফেলস বা বিডিআর নামক আধা-সামরিক বাহিনী বা প্যারামিলিটারি ফোর্স এবং আনসার ও ভিডিপি বাহিনী নামক সহায়ক সংস্থাকে স্থানীয় পর্যায়ে সংযুক্ত করা।
শহীদ জিয়ার মূল্যায়ন
মানুষ মরণশীল; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও মরণশীল ছিলেন। জীবন ও মৃত্যু মহান আল্লাহ তায়ালার হাতে; এখানে বান্দার হাত রাখার কোনো জায়গা নেই। মানুষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কোনো না কোনো দিন মারা যেতেন। পৃথিবীর বহু দেশের বহু রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা জাতীয় নেতা দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের দেশে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, পরিবশগত কারণে শাহাদত বরণ করেছেন। কিন্তু স্মৃতিতে অমর। চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে, ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম প্রহরেই তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ তারিখে কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে, প্রথমে নিজের নামে ও নিজের দায়িত্বে ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে একই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে পুনরায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরে সেক্টর কমান্ডার এবং ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তথা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। অতঃপর একজন শৃঙ্খলামুখী অফিসার হিসেবে ১৯৭৫ এর ২৪ আগস্ট সকাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে চাকরি করেন। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান হন।
৭ নভেম্বর ১৯৭৫, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব টলটলায়মান ছিল, তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সুদৃঢ়ভাবে, প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনীর এবং পরোক্ষভাবে পুরো জাতির হাল ধরেন। তিনি ছিলেন জনগণের হৃদয়ের মানুষ। তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। সামরিক শৃঙ্খলাকে, সামরিক আবেগকে তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়ে আসেন। তার রাজনৈতিক বিরোধীরা, তার সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্লেষণমূলক ব্যক্তিরা বিনা দ্বিধায় বলবেন যে, জিয়াউর রহমান সমন্বয়ের রাজনীতি, সহনশীলতার রাজনীতি, সমঝোতার রাজনীতি ও বহুদলীয় রাজনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। গবেষকগণ স্বীকার করেন যে, তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তৃণমূল মানুষের অংশগ্রহণে বিশ্বাস করতেন, কঠোর শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখায় বিশ্বাস করতেন। তিনি তরুণ ও মেধাবীদেরকে রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন; তিনি বন্দুকের যোদ্ধা থেকে কোদালের কর্মী হয়ে দেশ গড়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর এবং তার সঙ্গীরা, নিজেদের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, তারা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে ভুল করেছিলেন।
জীবনের দু’টি ঘটনার মোড়
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে তিন বছর চার মাস চাকরি করার পর, ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ, তৎকালীন মোশতাক সরকার জিয়াউর রহমানকে সফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করেছিল। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাসের মাথায় সংঘটিত হয় ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ঐতিহাসিক ঘটনা। জিয়াউর রহমান অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় জড়িত হওয়া শুরু করেন ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখ থেকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ১৯৭৭ সালে নিজে পদত্যাগকরত তৎকালীন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এই সময় থেকে, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত, জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন।
ক্রসরোডে বা জংশনে জিয়াউর রহমান
দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে একাধিক বিষয়ে যথা প্রশাসনিক বিষয়ে, উন্নয়ন বিষয়ে, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে, সামরিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তাকে কোনো-না-কোনো একটি মহাসড়ক বেছে নিতে হয়েছিল। এই কলামের পাঠকের চিন্তার সুবিধার্থে আমি উদাহরণস্বরূপ পাঁচটি অপশন বা বিকল্প যেটি সেই সময়ে জিয়াউর রহমানের সামনে উপস্থিত হয়েছিল সেগুলো এখানে লিখছি। তখন বাংলাদেশের সামনে বেছে নেয়ার জন্য রাস্তাগুলো ছিল নিম্নরূপ : (এক) উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পরিপূরক সড়ক অথবা, গণতন্ত্র ব্যতীত শুধু উন্নয়নের সড়ক। উল্লেখ্য যে, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে তত্ত্ব ও অভ্যাসগুলো সেগুলো হলো সততা বা অসততা, নীতি বা দুর্নীতি এবং সংযম অথবা লুটপাট। (দুই) মুসলিম বিশ্বের সাথে যথাসম্ভব সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে বাকি বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন অথবা, মুসলিম বিশ্বকে অবহেলা করে বাকি বিশ্বের সাথে দহররম-মহররম করা। (তিন) বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিবেশীদেরকে প্রাধান্য দিয়ে বাকি বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রাখা অথবা, প্রতিবেশীদেরকে অবহেলা করে বাকি বিশ্বের সাথে দহররম-মহররম করা। (চার) শিক্ষানীতি, সমাজনীতি অর্থনীতি ইত্যাদিতে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপস্থিতি রাখা অথবা, ধর্মীয় মূল্যবোধের উপস্থিতি না রাখা। ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পর্ক নৈতিকতা, সামাজিক আচার-আদব। (পাঁচ) দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কি বাকশালীয় তথা একদলীয় তথা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির মডেলটি অব্যাহত রাখা হবে নাকি বহুদলীয় উন্মুক্ত গণতন্ত্র পুনরায় চালু করা হবে? বাংলাদেশ কোন রাস্তাটা বেছে নেবে সেটি নির্ভর করছিল বাংলাদেশের তৎকালীন নীতিনির্ধারকমণ্ডলীর ওপর এবং সেই নীতিনির্ধারকণ্ডলীর কর্ণধার ছিলেন জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। আমরা এখানে সবগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারছি না স্থান অভাবে। শুধু দু’টি বিষয় আলোচনা করব; যথা বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সার্ক।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের সিদ্ধান্ত
জিয়াউর রহমান বহুদলীয় রাজনীতিকে বাংলাদেশে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন, যার ফলে আগে থেকেই পরিচিত বহু রাজনৈতিক দল নব উদ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ শুরু করে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের আগে তথা সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল নামক একক রাজনৈতিক দল কায়েমের আগে যেরকম আওয়ামী লীগ ছিল, সেই আওয়ামী লীগ পুনরায় কাজ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে যেই জামায়াতে ইসলামী ছিল, তারা সেই নামে আবির্ভূত হতে পারেনি তাই প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তারা ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ বা আইডিএল নামক দলের মাধ্যমে রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হন। কয়েক বছর পর আইডিএল বিলুপ্ত হয় এবং জামায়াতে ইসলামী পুরনো নামে পুনরায় রাজনীতি করা শুরু করে। ওই ধারাবাহিকতায় জামায়াতে ইসলামী এখন একটি বিশাল সুসংগঠিত গণতান্ত্রিক দল।
বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের ফলে তখন একাধিক নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপি। বিএনপি জিয়াউর রহমানের অমর সৃষ্টি। তাই বলা হয়, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট; অতঃপর ১৯৭৩-এর মার্চের নির্বাচনের পর থেকে তিনি হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী এবং এইরূপভাবে জানুয়ারি ১৯৭৫ পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেন। জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পুনরায় দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর, খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ চালান; মোশতাকই সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। মোশতাকের অপসারণের পর ৫ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে বিচারপতি সায়েম দেশ চালান। সেই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানও রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার অব্যাহত রেখেছিলেন।
জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোত্তম উসিলা
যারা জিয়াউর রহমানকে ভালোবাসেন, তাদের অনুভূতি হলো, জিয়াউর রহমান, ১৯ দফার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জন্য একটি ভিশন তুলে ধরেছিলেন। জিয়াপ্রেমিকদের অনুভূতি হলো, জিয়ার অনুসরণের মধ্যেই বিএনপির সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত। জিয়াউর রহমানের স্মৃতি কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়; জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক সাফল্য কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়- এই দু’টি কথা আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কলামের লেখক অর্থাৎ আমি নিজে একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং ২০ দলীয় জোটের অংশীদার একটি দলের প্রধান। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে আমি মনে করি, গত তেরো বছর ধরে বিএনপি নিজে কিছু ভুল করেছে এটা যেমন সত্য, তার থেকেও অনেক বড় সত্য হলো বিএনপির ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের খড়গহস্ত নেমে এসেছে এবং নিপীড়নের স্টিমরোলার এখনো চলছে। আমি মনে করি, বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিএনপিকে নির্মূল করা মানে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনীতিকে ক্ষতি করা বা নির্মূল করা। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি মনে করি, ধৈর্যের মাধ্যমে বিচক্ষণতার মাধ্যমে বিএনপির অখণ্ডতাকে সুরক্ষা দিতে হবে; এই কাজে আমি একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক সহযোগী হয়ে নিজেকে সৌভাগ্যমান মনে করি। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক ক্যারিশমা ও দেশ গঠনের আদর্শকে ক্ষতি করার জন্য অতীতে বহু চক্রান্ত হয়েছে; বর্তমানেও যে হচ্ছে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? অতএব সাধু সাবধান!
উপসংহার
পার হয়ে যাওয়া জন্মদিন উপলক্ষে আজকের কলামটি, জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি মাত্র। অন্যরা যেন জানতে আরো আগ্রহ প্রকাশ করেন, তার জন্য উৎসাহের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে সঙ্কট আছে। অতএব আমাদের অতীতের উজ্জ্বল রাজনৈতিক নক্ষত্রগুলোর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বীর উত্তম জিয়াউর রহমান অল্পসংখ্যক নক্ষত্রের মধ্যে অন্যতম একজন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : [email protected]