বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত, চীন ও রাশিয়া নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। এই লক্ষ্য অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতিসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো মধ্যপন্থা অবলম্বন করছে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশে আলোচনাকে সম্মানজনক নয় বলে অভিহিত করেন। তারা অভ্যন্তরীণভাবে আলোচনা করে সংকট সমাধানের তাগিদ দিয়েছেন।
তারা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে দেশগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক মেরুকরণ রয়েছে। বাংলাদেশকে তাদের সেই লড়াইয়ের ক্ষেত্র বানানো হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানের মধ্যে কিছুটা ধূম্রজাল ছিল। দিল্লিতে শুক্রবার ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২+২ বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়-যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এভাবেই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে ভারত।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে ২+২ বৈঠকে অংশ নেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানান, বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দুদেশের নেতারা আলোচনা করেছেন।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিনয় কোয়াত্রার কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা।
উত্তরে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। তাই বাংলাদেশের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট তুলে ধরেছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। তৃতীয় কোনো দেশের নীতিমালা নিয়ে আমাদের মন্তব্য করার জায়গা নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের মানুষ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, এক বন্ধু এবং সঙ্গী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আমরা সম্মান জানাই। একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে সে দেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ভিশনকে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে। বাংলাদেশকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে সে দেশের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারত বরাবর সমর্থন করে আসছে। এই সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
দৃশ্যত ভারতের এ অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের থেকে ভিন্ন। চীনের প্রভাব মোকাবিলার লক্ষ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু হলেও বাংলাদেশের প্রসঙ্গে তারা একমত নন। বরং দিল্লি ও ওয়াশিংটন এই ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড়।
ভারতের বক্তব্যের একদিন আগে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়ো ওয়েন বলেছেন, বাংলাদেশে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে এই দেশের আইন মেনে নির্বাচন প্রত্যাশা করে চীন। এই ক্ষেত্রে বাইরের চাপ কিংবা হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। কিছুদিন আগে রাশিয়াও প্রায় একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সমালোচনা করেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় বলে জানিয়েছে। দেশগুলো সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে পর্দার আড়ালে তৎপরতা চালাচ্ছে।
যদিও বাংলাদেশে সংকট নিরসনে বিদেশি তৎপরতা সফল হওয়ার ঘটনা দৃশ্যমান নয়। তবে বাংলাদেশে এই সব দেশের রাষ্ট্রদূতরা দৌড়ঝাঁপ করছেন। তারা বলছেন, রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে তাদের মধ্যস্থতা দুই পক্ষের দূরত্ব কমাবে বলে আশা করেন। সবাই তাই তফশিলের আগেই সংলাপ চান।
বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে পশ্চিমা দেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের আলোচনা প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, প্রতিটি দেশ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, জাতীয় স্বার্থের আলোকে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। আমি মনে করি যে, বাংলাদেশ নিয়ে যে ধরনের আলোচনা বাইরে হয়েছে, সেটি না হওয়াটাই ভালো হতো।
কারণ, আমরা যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারতাম তাহলে সেটি সবচেয়ে বেশি সম্মানজনক হতো। আমাদের একেবারেই নিজেদের বিষয়গুলো নিয়ে বাইরে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। তারা তাদের অবস্থান জানাচ্ছে, এতে খুব সাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। এটি আত্মসম্মানজনক বিষয় বলেও মনে হয় না।
দেশের একজন সাধারণ নাগিরক হিসাবে মনে করি, বাইরে কে কি করবে তাতে মনোযোগী না হয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতা যারা আছেন, যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন। তারা এখানকার মানুষের প্রত্যাশা, মানুষ কি চায় তার প্রতি দৃষ্টি রাখতে পারেন। সেটাকে মূল্য দিয়ে তারা নিজেরা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এ সমস্যাগুলো সমাধান করলেই আমরা যে প্রত্যাশিত পর্যায়ের সম্মান নিয়ে থাকা দরকার সে সম্মানটা নিয়ে থাকতে পারতাম।
তিনি বলেন, আমরা যদি শুভবুদ্ধি প্রয়োগ করে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারতাম তাহলে সবেচেয় উত্তম ব্যবস্থা হতো। যে আত্মসম্মানের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সে আত্মসম্মান হয়তো সমুন্নত থাকত।
তিনি বলেন, এই সংঘাতময় পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে বা এটি যদি দীর্ঘায়িত হয়, নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যদি প্রশ্ন তৈরি হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আলাদাভাবে আমেরিকা এবং কিছুটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়া বাকি দেশগুলো সব সময় বলে এসেছে যে, এই নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমাদের নাক গলানোর কোনো বিষয় নয়। যে ঘাটতি আছে সেটি আমাদের দ্বারা মেটানো সম্ভব নয়, সেটা বাংলাদেশে জনগণকেই ঠিক করতে হবে। সেখানে মূলত বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে আমেরিকাই তার বেশি অতি উৎসাহ দেখিয়েছে। যদিও আগেও কম-বেশি হয়েছে এমনটা।
তিনি আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার আলোচনায় ভারত তার অবস্থান স্পষ্ট করতে পেরেছে। আগেও করেছে। তারা বলেছে, নির্র্বাচন বাংলাদেশর অভ্যন্তরীণ বিষয়। তারাই ঠিক করবে কিভাবে সেটি পরিচালনা করবে।
এখানে মনে রাখতে হবে, ভারত এই সময়ে এই কথা বলার বড় কারণ, স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশে তারা একটি বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে চাইবে। সেদিক এই সরকার সন্দেহাতীতভাবে ভারতের বড় মাথাব্যথা নর্থ-ইস্ট যে নিরাপত্তা সেটি বড় আকারে সমাধান করেছে। দেখিয়েছে এটা করা সম্ভব। তাই ভারত কেন আবার তাকে নতুন ঝুঁকিতে ফেলবে। বিরোধী দল যারা এক সময় ক্ষমতায় ছিলেন তখন বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে দশ ট্রাক অস্ত্র, উলফার কথা আমরা জানি।
তিনি বলেন, একইসঙ্গে ভারত কখনো চাইবে না বাংলাদেশে আমেরিকার একটা নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি হোক। কারণ, পাকিস্তানে যে কাঠামো তৈরি করেছে আমেরিকা সেটার ভুক্তভোগী তারা। তাই ভারত চাইবে না এখানেও আমেরিকা তার ইন্টেলিজেন্স, তার অস্ত্র নিয়ে একটা নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করুক। আজকে হয়তো এই সরকার আছে, কিন্তু সেটা কখনো পরিবর্তন হতে পারে। তখন হয়তো ওই কাঠামো দিল্লির জন্য আরেকটা বড় মাথাব্যথা হয়ে যাবে। ভারতও বড় শক্তি। তাই তারও আমেরিকাকে হয়তো বলেছে, তোমার সঙ্গে আমার যতই বন্ধুত্ব থাকুক আমি চাইব এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো যেন আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে। সাবেক
রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, ভারত বলেছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। আবার এটাও বলার চেষ্টা করছে যে নির্বাচনে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে এবং এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান হবে। এই অঞ্চলে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ভুটানে, নেপালে, শ্রীলংকা, সদ্য মালদ্বীপে হয়েছে। এতে তো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়নি। বাংলাদেশে মানুষ কারও হস্তক্ষেপই পছন্দ করে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন হবে। সেখানে ভারত কেন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করছে। ভারত চাইছে বাংলাদেশে ‘স্ট্যাবিলিটি’ বা এই সরকারই থাকুক। যেভাবেই হোক এই সরকারই থাকুক তাদের স্বার্থে।
যুগান্তর