জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কী?

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে একই সাথে সরকারি ও বিরোধী দলের রোল প্লে করতে করতে জাতীয় পার্টি শেষ। এককভাবে নির্বাচন করলে তারা সারা দেশে সর্বোচ্চ ২-৩ টি আসন পেতে পারে, এমনকি পার্টির প্রেসিডেন্ট জি এম কাদেরের আসনটিও সুরক্ষিত নয়। রংপুরে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগ সবার ভোট বেড়েছে, কমেছে জাপার। এমন কমা কমেছে যে, সবদলের অংশগ্রহণে জোট মুক্ত একক ভোট হলে জাপা রংপুরের সবগুলো আসনেই হেরে যেতে পারে। এরশাদ বেঁচে থাকলে একাই রংপুরের ৫ আসনে জিতে দলটার মান বাঁচাতেন। কিন্তু সেই রিয়েলিটি এখন আর নাই।

জাপার তৃণমূলের প্রায় সব নেতা আপত্তি করলেও আওয়ামী লীগের গৃহপালিত জাপা এমপি’রা নির্বাচনে যেতে চেয়েছেন। ভোটহীন ক্ষমতার মজাটা তারা ধরে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন, জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চ, ইসলামী ঐক্য জোটের একাংশ নির্বাচনে না যাওয়ায়, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর দায়ে শেখ হাসিনাকে বিকল্প প্রার্থী ও ডামি প্রার্থীর কৌশলে যেতে হয়েছে। এতে জাপা এমপি’রা বুঝতে পারছেন তারা স্বতন্ত্র কিংবা ডামি প্রার্থীর কাছে হেরে যাবেন। এটাই সঠিক ক্যালকুলেশন।

কিন্তু শেখ হাসিনা তাদের আবদার রাখতে পারবেন না, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের, ডামিদের, স্বতন্ত্রদের তিনি সরে যেতে বলবেন না।

জাপার করণীয় কী ? প্রাথমিক কাজ হচ্ছে মান ইজ্জত বাঁচাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো। মধ্যমেয়াদে করণীয় হচ্ছে, গৃহপালিত বিরোধী দল না হয়ে মানুষের এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতি করা। আর দীর্ঘমেয়াদে, দলটার কাজ আওয়ামী লীগের সাথে ঘুটু না করে প্রকৃত রাজনীতিতে ফেরা। জাতীয় পার্টির কোনো মিশন-ভিশন নেই, দলে কোনো পলিসি স্ট্যাডি নেই। এই দলে কোনো বুদ্ধিজীবী নেই, গবেষণা ইন্টারফেইস নেই, পরিকল্পনা নেই, কোনো রূপরেখা নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরের জন্য কোনো সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে তাদের কোনো কাজ নেই।

জাতীয় পার্টি এখন আর দেশের ৩য় বা ৪র্থ দল নয়। আওয়ামী লীগ আমলের গত ১৫ বছরের স্থানীয় ও উপ-নির্বাচনগুলোতে তারা ইসলামী আন্দোলনের চেয়েও কম ভোট পেয়েছে। শুধু কম না, অধিকাংশ এলাকায় অনেক কম পেয়েছে এবং জাপা প্রার্থীরা জামানত হারানোর পর্যায়ে চলে গেছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনের পরে তারা এখন দেশের সর্বোচ্চ ৫ম দল হতে পারে। গণঅধিকার মঞ্চসহ বেশ কিছু নতুন দল এসেছে বলে জাতীয় ভোটে তাদের প্রকৃত পজিশন এর চেয়েও পেছনে হতে পারে। দেশে সুষ্ঠু ভোট নেই বলে বিষয়টি সামনে আসছে না।

জাপা বরাবরই ভারত থেকে সাহায্য-সহযোগিতাপ্রাপ্ত দল। পরজীবিতা, নেগোসিয়েশন কেন্দ্রিক রাজনীতি তাদের প্রধান সমস্যা। আঁতাতের রাজনীতি তাদের নিঃশেষ করেছে। নেগোসিয়েশন করে জাপা দিন আনে দিন খায় টাইপ রাজনীতি করে, আওয়ামী তল্পি বহন ছাড়া রাজনীতিতে দলটির কোনো অবস্থান নেই। বলা চলে আওয়ামী লীগ এবং মিডিয়াই দলটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

 

দুই 

জাতীয় পার্টি দলটাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয়! দলটার ভবিষ্যৎ কি টেকসই? দলটার ধীরগতির বিলুপ্তি অব্যহত থাকলে আদৌ কোন লাভ হবে বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতির? দলটার জন্য আমার সহানুভূতিও কাজ করে। ক্ষমতা কেন্দ্রের বাইরের যেকোনো বৈধ রাজনৈতিক শক্তিকে (লেজিটিমেট পলিটিক্যাল ফোর্স) রাজনীতির মাঠ থেকে হঠাৎ আউট করে দিলে, কিংবা বলপ্রয়োগে শক্তিহীন করলে- ১) দেশে আসলে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার পথ সুপ্রশস্ত হয়। ২) ভুলভাল হলেও ‘এন্ড টু এন্ড’ পলিটক্যাল এজেন্ডা নেই এমন, রাষ্ট্র/জনতার প্রতিনিধিত্ব না থাকা শক্তিকে বিরোধী রাজনীতিতে খরিদ করে এনে কর্তৃত্ববাদকে/স্বৈরাচারকে জাস্টিফাই করার চেষ্টাগুলো দীর্ঘমেয়াদে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের ক্ষতি করে। কিংস পার্টিকে সুবিধা দিতে প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্র প্রযোজিত অনাচার করতে হয়।

সরকারপন্থী এলিটদের সমর্থন নিয়ে বিএনপি দমনের বিগত এক যুগে এই বিষয়টা আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কেউ মাথায় রাখেনি, কিন্তু পরে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে মেকি হাহাকার করেছেন। ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কেউ কেউ চিন্তায় বসেছেন, কিভাবে ড্যামেজ কন্ট্রোল করে, কম ক্ষতিতে কর্তৃত্ববাদী দৈত্য সরানো যাবে। সমস্যা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনে হেরে যেতে পারে এই ভেবে বুদ্ধিজীবীদের হাতে রাতের ভোট ছাড়া ভিন্ন কোনো সমাধান নেই।

কিন্তু সত্যিকার দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের আন্তরিকতার অভাব কেন এটা আমাকে ভাবায়! কখনই জাপাকে বুদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শ দিতে শোনা যায় না।

 

 

বিএনপিকে অনেক গালাগালি, সামাজিক চাপ, নাগরিকের সমাজের চাপ সইতে হয়েছে বিগত দশকে। আশার কথা এর মাধ্যমে দলটির কিছু শিক্ষাও হয়েছে। রাজনীতিতে বিএনপির কনফিডেন্স ও প্রস্তুতি কম বলে তাকে গালাগালি করলে, চাপ দিলে সে শুনে। ফলে সে ক্ষমতায় আসলে শিক্ষা নিয়ে কী করবে, বিদ্যুৎ নিয়ে কী করবে, আর্থিক সংস্কার নিয়ে কী করবে- এমন কিছু চিন্তা করেছে, দলীয় ফোরামে এবং সংবাদ সম্মেলন করে এগুলা বলেছে। তার আগে ৩১ দফার একটা সংস্কার প্রস্তাবনা এবং ভিশন ২০৩০ রূপরেখা আছে। বিএনপি নিয়ে যারা খোঁজ রাখে না, তারা এসব জানেন না হয়ত। কিন্তু ভুলভাল হলেও কাজগুলা তারা করেছে। এমনকি মধ্যপন্থী ও উদার বামের ছোট ছোট দলের সাথে বসে সে রাষ্ট্র সংস্কারের একটা রূপরেখায় সম্মতও হয়েছে। এখানে তার আন্তরিকতা কতটা সেটা সময়ই বলে দিবে, তবে বিএনপি যে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে, সংবিধান সংস্কারে রাজি হয়েছে এটা বাংলাদেশের ছোট ছোট মধ্যপন্থী দলগুলোকে সাথে নিয়ে বিএনপির সাম্প্রতিক একটা অর্জন বলবো। বিএনপির ভিশন-২০৩০ পুরনো হয়ে গেছে, এতে লক্ষ্যগুলো অস্পষ্ট, কিছু ক্ষেত্রে ভেগ, অর্থাৎ এটা নবায়ন করার দরকার আছে সত্য, কিন্তু তারপরেও তাদের হাতে ভুলভাল  হলেও একটা কিছু আছে।

কিন্তু জাতীয় পার্টির হাতে জাতীয় রূপরেখা বলেন, খাতভিত্তিক রুপরেখা বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার বলেন- এমন কিছুই নেই। এই শূন্যতাটা কেন হল? মূল কারণ জাতীয় পার্টি তার দলে বহুবিধ ডোমেইনের মেধার সংযোগ ঘটাতে পারেনি। বিচ্ছিন্নভাবে জাপায় দু’একজন বক্তা এসেছে, কিন্তু তাদের এন্ড টু এন্ড পলিসিগত জ্ঞান সীমিত। জাপাতে রিয়েল পলিসি মেকার নেই কেউ, এটাই বড় শূন্যতা, একটা রাজনৈতিক দল এভাবে টিকে থাকে না।

বাংলাদেশ নিয়ে জাপার ভিশন-মিশন কি, এমন প্রশ্ন করা হলে জাপা কোনো পেপার ওয়ার্ক দেখাতে পারবে না। কী আজীব কথা!  বড় প্রশ্ন হচ্ছে, কেন জাতীয় পার্টিকে দেশের বুদ্ধিজীবীরা গাইড করলো না, চাপ দিল না! জাপা তো আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সতীন না!

জাপা বলতে গেলে ২০০৯ থেকেই সুবিধা নিয়ে রাজনীতি করছে। এই সময়ে রাজনীতিতে তার অর্জন কী? যে দলটা অনুকূল সময়ে ভবিষ্যৎমুখী  সঠিক  রাজনীতিটা করতে পারলো না, সে বৈরী সময়ে কী করবে?

এই নিয়ে জাপার আদৌ কি কোনো উপলব্ধি আছে? জাপার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি নেই। পলিসিগত সংস্কার প্রস্তাবনা নেই। এমনকি জনস্বার্থ ইস্যুতেও তার কোনো স্টেইক নেই। কেন নেই? গুম-খুন, পুলিশি হয়রানি নিয়ে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে, বিদ্যুৎ-গ্যাস-জ্বালানি-পানির দাম বৃদ্ধিতে, ব্যাংক লুটের বিরুদ্ধে, উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রের অর্থ লুটের বিরুদ্ধে জাপার কোনো আন্দোলন কেউ দেখিনি! এই এক অদ্ভূত আত্মহত্যা!

এরশাদ সাহেব মরে গেছেন। ফলে আজকের জাপা’কে ব্যক্তি নির্ভর রাজনীতি থেকে বুদ্ধির রাজনীতিতে, পলিসিগত রাজনীতিতে যেতে হবে। টিকতে হলে রাজনীতিতে জনস্বার্থকে ঢুকাতে হবে, তাকে নাগরিক প্রতিবাদে, গণআন্দোলনে পার্টিসিপেইট করতে হবে।

 

 

রাজনীতিতে এরশাদ খুব প্রেডিক্টেড ছিলেন। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনা করে নেগোসিয়েশন ও বার্গেইন পাওয়ার বাড়িয়ে দিনশেষে আওয়ামী লীগের জোটে তরী ভিড়ানোই উনার ধারাবাহিক পলিসি ছিল। এরশাদ হয়ত শেষদিকে (২০১৮) এসে স্বাধীন হবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁর চরিত্রের ও অর্থের নাটাই সরকারের হাতে ছিল বলে এগুতে পারেননি।

জি এম কাদেরের সামনে চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। একদিকে জাপা জাতীয় স্বার্থকে ‘বৃহত্তর পলিসিগত’ অর্থে রিপ্রেজেন্ট করছে না, অন্যদিকে দলের একাংশের সাথে সরকারের গভীর যোগাযোগে তিনি পরাধীন। দল এই ভাঙলো, এই ভাঙলো করে। ২০১৭ সালে তাঁর সাথে আমার দুবাই এয়ারপোর্টে দেখা হয়। আলাপে তাঁকে অত্যন্ত দুর্বল, কনফিডেন্সহীন এক নিপাট ভদ্রলোক মনে হয়েছে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, উনি শেখ হাসিনার অধীনস্থ নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন। উনি কি স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠায় জাপার অবদানকে স্বীকার করার সততা রাখেন! যদি রাখেন তখনই উনি দলের পলিসিগত সংস্কারে নেতৃত্ব দিতে পারবেন!

 

জি এম কাদেরের সমসাময়িক বেশ কিছু সাক্ষাৎকার (প্রথম আলো, মানবজমিন) পড়ে আমার মনে হয়েছে, উনি আগের চেয়ে কথাবার্তায় অনেক ম্যাচিউর। কিন্তু তাঁকে ম্যাচিউরিটি দেখাতে হবে অন্য অনেক জায়গায়- জাপার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক সংযোগ করাতে হবে, দেশের প্রত্যেকটি খাতে জাপা কী কী সংস্কার চায় তার উত্তর নিয়ে হাজির হতে হবে। কর্তৃত্ববাদী সরকারকে রিপ্লেইস করতে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা, দেশের সম্পদ ব্যস্থাপনার রুপরেখা নিয়ে হাজির হতে হবে।

সরকারের ঠাণ্ডা ও গরম সমালোচনা করে ‘বার্গেনিং পাওয়ার’ বাড়িয়ে তলে তলে আতাত করে সংসদে কয়েকটা ‘বিরোধী দলীয়’ আসন ধরে রাখার রাজনীতি করে জাপার তো কর্মী বাড়েনি, সংগঠনও বিস্তৃত হয়নি বরং বেশ কমেছে। আর প্রক্সি হয়ে কাজ করা রওশন গ্রুপের সাথে যুদ্ধ করাও জি এম কাদেরের একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। দেশের রাজনীতিতে জাপা টিকে থাকুক। জি এম কাদের যোগ্যতাসম্পন্ন নিপাট ভদ্রলোক। রাজনীতিতে ভদ্রলোকের দরকার আজ খুব বেশি। সাথে সাথে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রয়োজনও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। তাই মানুষের কাছাকাছি গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো টিকে থাকুক এটাই চাই।

Manabzamnin