জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে ছিল রাষ্ট্র গঠনের দিকনির্দেশনা; সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২২


সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণ ছিল একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য দিকনির্দেশনাপূর্ণ।

স্মরণীয় যে. ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ ছিল সংগ্রামী আগামীর ইঙ্গিত। আর ১০ জানুয়ারির ভাষণ সেই সংগ্রামী সাফল্যের পথ-নকশা। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাষ্ট্রদর্শন পরিস্কার হয়ে উঠেছিল।

প্রথমত, এতে বঙ্গবন্ধুর একটি আত্মতৃপ্তি ও আত্মশ্নাঘাবোধ ছিল বাঙালির অর্জনের কারণে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন।’ এমনকি তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন- ‘কবিগুরু, তুমি দেখে যাও; তোমার বাঙালি আজ স্বাধীন হয়েছে।’ অবশ্য বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে তার এই আত্মতৃপ্তি যে প্রশ্নবিদ্ধ হতো, তা তিনি বুঝতেন।

একই সঙ্গে তার আত্মবিশ্বাস আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বন্দি ছিলাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল- বাঙালি স্বাধীন হবে।’ বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাস সব সময় তার কর্মপ্রীতির পাটাতন নির্মাণ করেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ জানুয়ারিতে দেওয়া ১৭ মিনিটের ভাষণে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, তিনি এতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারিত্র্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। যেমন, তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বসবাস করবে। সুখে থাকবে।’ ‘বেকার যুবকরা যদি কাজ না পায়, মানুষ যদি পেটপুরে খেতে না পারে, তাহলে এ স্বাধীনতা মিথ্যে হয়ে যাবে।’ লক্ষণীয়, ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তির কথা একাধিকবার বলা হয়েছিল। সেই মুক্তির কথা আবারও বলা হলো স্বাধীন বাংলাদেশে। একটি কথা পরিস্কার- বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতা চাননি; স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিও চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর মুক্তির প্রসঙ্গটি তাই এত জরুরি হয়েছিল তার কাছে।

বাঙালির রাষ্ট্রটি কেমন হবে, তার ভিত্তি কী হবে, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট ঘোষণা ছিল- ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে; যার ভিত্তি কখনও ধর্মভিত্তিক হবে না। বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ আমরা জানি, সংবিধান রচনার সময় আরও সংযুক্ত হয়েছিল জাতীয়তাবাদ। ফলে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হয়ে যায় চারটি। বাহাত্তরের ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে বললেন, ‘বাংলাদেশের আদর্শ ঠিক হয়ে গেছে। এই আদর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশ চলবে।’ কিন্তু ৫০ বছরের বাংলাদেশে সুবর্ণজয়ন্তীর সময় আমাদের প্রশ্ন :বাংলাদেশ কি চলছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আদর্শের দ্বারা? যদি রাষ্ট্রের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের ভিত্তি কি ধর্মভিত্তিক হয় না? আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশে এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনেকটা যেন জোড়াতালির ব্যাপার।

১০ জানুয়ারির এই ভাষণে দেশ গঠনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অন্তত ১৫টি দিকনির্দেশনা ছিল। তবে সবচেয়ে বড় দিকটি হলো, বঙ্গবন্ধু তার জীবনদর্শন তুলে ধরেছিলেন স্বতঃস্ম্ফূর্ত, অলিখিত এই ভাষণের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান।’ বোঝা যাচ্ছে, আমাদের আত্মপরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার মনুষ্যত্ব, বাঙালিত্ব এবং মুসলমানত্ব একই সমান্তরালে অবস্থান করছিল। তবে বাঙালি সম্পর্কে ধারণা ছিল অনেক উঁচু। তাই তিনি ১০ জানুয়ারি দ্বিধাহীন ভাষায় বলতে পেরেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। বাংলার মাটি আমার স্থান।’ তার কাছে এমনটাই মনে হয়েছিল; জীবনানন্দ দাশের পঙ্‌ক্তিতে বলা যায়, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’। এভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি বাংলা ও বাঙালির প্রতিকৃতি ছিলেন।

৭ মার্চের ভাষণ যে কারণে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে ১০ জানুয়ারির ভাষণ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের নিরিখে ভাষণ দুটি একে অপরের পরিপূরক। মোদ্দা কথা হলো, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ভাষণ দুটি।