জাতিগত জাতিসত্তা ও বাংলাদেশের অবস্থান

Daily Nayadiganta

বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশই বাঙালি। বিশাল এ জনগোষ্ঠী মুসলিম ও হিন্দু এ দু’টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত। তা ছাড়া বাংলাদেশে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ৪৫ প্রকারের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। এসব উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠীর অনেকের নিজস্ব ভাষা থাকলেও আবার কতিপয়ের ভাষা বাংলা। নিজস্ব ভাষাভাষী উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী বাংলা বলতে ও বুঝতে সক্ষম। কোনো দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার প্রায় সবাই এক ভাষাভাষী হওয়া এবং সবার একই ভাষা বলা ও বুঝার সক্ষমতার সমরূপতা পৃথিবীর আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাসে বিরল।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং অপরাপর জনগোষ্ঠী ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ বা উপ-সম্প্রদায় হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিবিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ২৩ক সন্নিবেশনের মাধ্যমে বলা হয় রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশনের ফলে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও এ দেশে জন্মগতভাবে বসবাসরত সব নাগরিক যেমন বাঙালি, অনুরূপ এ দেশে বসবাসরত সব উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ও যে বাঙালি, সেটির সুস্পষ্ট স্বীকৃতি মিলেছে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। উভয় রাষ্ট্র উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জাতি সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। ভারতবর্ষ বিভাজন-পরবর্তী ২৩ বছরের মাথায় জাতিগত জাতিসত্তার ভিত্তিতে তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বিভাজিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে ভারত ধর্মীয় জাতিসত্তার নীতি হতে বিচ্যুত হয়ে জাতিগত জাতিসত্তার সপক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

এ মূলনীতিটির উপদফা (খ) এ ব্যক্ত হয়েছে রাষ্ট্র- প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে। এ বিষয়ে যদিও আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়নবিষয়ক অনুচ্ছেদটির মূল দফায় শর্তারোপ করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধে শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসঙ্ঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা, প্রভৃতির অনুসরণে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি রচনার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু যখন যেকোনো জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করার কথা ব্যক্ত হয় তখন যেকোনো জাতির জাতিগত জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধিকারের দাবির বিপক্ষে অবস্থান নেয়া অনুচ্ছেদটিতে উল্লিখিত এতদসংক্রান্ত অধিকারের সাথে স্ববিরোধী।
ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে সৃষ্ট, সাবেক পাকিস্তানের পূর্বাংশের জনগণের বাঙালি জাতিসত্তা দেশটির পশ্চিমাংশের জনগণের জাতিসত্তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবার পাকিস্তান রাষ্ট্রটির পশ্চিমাংশের সব জনগণের জাতিসত্তা অভিন্ন নয়। পাকিস্তানের চেয়ে ভারত আরো অনেক বেশি জাতিসত্তা সমন্বয়ে গঠিত। পৃথক জাতিসত্তার দাবিদার পাকিস্তানের অন্তত একটি প্রদেশের জনগণের পক্ষ থেকে প্রায়ই স্বাধিকারের দাবি উত্থাপিত হতে দেখা যায়। ভারতের একাধিক রাজ্যের জনগণের পক্ষ থেকেও দীর্ঘ দিন ধরে এ দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছে। উভয় দেশের সরকার কঠোরভাবে নিজ নিজ দেশে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধিকারের দাবিকে অবদমিত করার জন্য বদ্ধপরিকর হলেও একে অপর দেশের এ ধরনের দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে আসছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যক্ষ সহায়তার প্রয়াস পাচ্ছে।
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের বালুচিদের জাতিগত জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধিকারের দাবির প্রতি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন খুব একটা জোরালো নয়; অপর দিকে ভারতের কাশ্মির রাজ্যের কাশ্মিরিদের স্বাধীনতার দাবি, পাঞ্জাব রাজ্যের শিখ ধর্মাবলম্বীদের স্বাধীন ‘খালিস্তান’ রাষ্ট্রের দাবি, আসাম, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের যথাক্রমে অহমিয়া, মিজো ও নাগাদের পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবির প্রতি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমান্বয়ে প্রবলতর হয়ে উঠছে।

১৯৩৫ সাল অবধি বার্মা বা মিয়ানমার ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ ছিল। ১৯৪৮ সালে বার্মা যখন ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে তখন বার্মার আরাকান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত প্রদেশ ছিল। রোহিঙ্গারা বার্মায় বসবাসরত অন্যান্য জাতির মতো একটি পৃথক জাতিসত্তা। বার্মার প্রথম ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপ্রধান যথাক্রমে জেনারেল অংসান ও উনু রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে ভোটাধিকার প্রদান করেছিলেন। জেনারেল নেউইন বার্মার রাষ্ট্রপ্রধান হলে তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে ১৯৬২ সাল থেকে তাদের আরাকান থেকে বিতাড়নের নিপীড়নমূলক প্রক্রিয়া শুরু করেন, যা এখনো অব্যাহত আছে। বার্মার স্বাধীনতাকালে আরাকানের আয়তন ছিল ২০ হাজার বর্গমাইল। পরে বার্মার সামরিক শাসকরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রোহিঙ্গাদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করার প্রয়াসে আরাকান পার্বত্য জেলা ও আরাকানের দক্ষিণাঞ্চলকে পৃথক করে ১৪ হাজার ২০০ বর্গমাইল এলাকা বিশিষ্ট আগেকার আরাকান প্রদেশটির ‘রাখাইন’ নামকরণ করেছেন। রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং আমাদের দেশে তারা ‘মগ’ নামে অভিহিত। বার্মার স্বাধীনতাকালে আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ। দীর্ঘ দিন অত্যাচার, নিষ্পেষণ, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনের কারণে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ২০১৬ সালে ১৩ লাখে ঠেকে। বর্তমানে যে অবর্ণনীয় ও পৈশাচিক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়ে চলছে তাতে প্রদেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবশিষ্টাংশের প্রায় অর্ধেক অনন্যোপায় হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গারা হাজার বছরের অধিক সময় ধরে বংশপরম্পরায় বার্মায় বসবাস করায় তারা তথাকার অপরাপর জাতিসত্তার মতো পৃথক জাতিসত্তা। রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া না হলে অপরাপর জাতিসত্তাকেও বার্মার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার যুক্তি নেই। বার্মার শাসকরা বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে তথায় শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি না করলে তারা যে বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে যাবে, এ সত্যটুকু উপলব্ধি করে হলেও বার্মার শাসকদের সমস্যাটির সম্মানজনক সমাধানে অবিলম্বে পৌঁছানো উচিত।

প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনে বিশ্বাসী কিন্তু বিভিন্ন জাতিসত্তা সমন্বয়ে গঠিত, পৃথিবীর এমন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধিকারের দাবি প্রবলতর হলে সেটি নির্ধারণের ভার গণভোটের মাধ্যমে জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের অধিবাসীদের জাতিসত্তা স্কটিশ হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ততক্ষণ পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা জাতি হিসেবে ‘ব্রিটিশ’ নামে অভিহিত। স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (এসএনপি) স্বাধিকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্কটল্যান্ডে ২০১৪ সালে গণভোট দেয়া হলে প্রায় দশ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে স্বাধীনতাকামীরা পরাভূত হয়েছেন। পরে ২০১৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি নির্বাচনে দেখা যায়, স্বাধিকারের সপক্ষের দল এসএনপি স্কটল্যান্ডের জন্য নির্ধারিত ৫৯টি আসনের মধ্যে ৫৬টিতে বিজয়ী। এ বিজয়দৃষ্টে স্কটল্যান্ডের জনগণের মধ্যে যারা স্বাধিকারের পক্ষে তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে যে, পুনঃগণভোট দেয়া হলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্কটল্যান্ডের অভ্যুদয় ঘটবে। যুক্তরাজ্যের মতো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জনগণের মধ্যে স্বাধিকারের দাবির প্রতি যে জনসমর্থন রয়েছে তার প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশরূপে যদি গণভোট দেয়া হয় তাতে জন-আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে ভারতের যেসব রাজ্যে স্বাধিকারের দাবি সোচ্চার, সেসব রাজ্যের জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। কিন্তু এ বিষয়ে জনগণের আকাক্সক্ষা যত প্রবলই হোক না কেন ভারত গণভোটের পরিবর্তে শক্তি দিয়ে যে তা অবদমিত করবে এটি দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত, তাদের আচরণে প্রমাণিত।

যুক্তরাষ্ট্রের ৫৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরবর্তী নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি রাজ্যের পক্ষ থেকে স্বাধিকারের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। দেশটির নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এ ধরনের অনিয়ম ও কারচুপি অব্যাহত থাকলে তা দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের জনগণের মধ্যে স্বাধিকারের দাবি যে প্রবলতর করবে, তা দেশটির সচেতন জনমানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম। এমতাবস্থায় দেশটির অখণ্ডতা অক্ষুণœ রাখতে সে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলাদেশ জাতিগত জাতিসত্তার নীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে ভারত ও পাকিস্তানসহ পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলে জাতিগত জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি তথাকার জনগণের ব্যাপক সমর্থন থাকলে বাংলাদেশের এর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা দেশটির এ বিষয়ে ধারণকৃত সাংবিধানিক চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

E-mail: iktederahmed@yahoo.com