পলাশীর যুদ্ধ গত। ক্ষমতায় ব্রিটিশ কোম্পানি। নামমাত্র নবাব রেজা খান। চালু হয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। নবাবি আমলে যে জমিদারেরা গাঁয়ে থাকতেন, গাঁয়ের ভালো-মন্দের অংশীদার ছিলেন, তাঁদের জায়গায় এলেন জেলা প্রশাসকেরা। তাঁরা হলেন একই সঙ্গে স্বাধীন কাজি বা বিচারকদের ঊর্ধ্বতন। সঙ্গে এল ৫ সনা ও ১০ সনা ব্যবস্থার পর চিরস্থায়ী জমিদারি বন্দোবস্ত। নির্দিষ্ট খাজনার বিনিময়ে জমির মালিকানা কৃষকের হাত থেকে তাঁদের হাতে চলে গেল। কৃষকের ভাষায়, ‘জমিদার হৈল ইজারাদার। —রাজা হৈলে দয়া বুঝে করিত পালন/পরে দয়া নাহি বুঝে বেসি লইতে মন।’ আর এই জমিদারদের সবার ঠিকানা হলো কলকাতা নগরী। কুড়িগ্রামের বর্তমান উলিপুরের বাহারবন্দ পরগণার কৃষকের ভাষায়: ‘এক বারি কাশিম (বাজার) বারি বানজিটা।/ এক বারি আছে রাজার সহর কলিকাতা। —ধন কাঙ্গালি হৈল রাজা রাজ্যেরও ভিতর/ এয়ার বিচার করবেন ধর্ম নিরঞ্জন।’
১৭৭২ সাল। রানি ভবানী ও তাঁর জামাই দুর্ভিক্ষের কারণে জমামাফিক খাজনা হাসিল করতে পারেন না। ফলে বৈষ্ণব চরণ নন্দীর নামে কৃষ্ণকান্ত নন্দী বেনামে জমিদারি ইজারা নেন। ১৭৭৯ সালে কৃষ্ণকান্ত গোটা পরগণাই নির্দিষ্ট জমার বিনিময়ে স্থায়ীভাবে ইজারা নেন। হেস্টিংসের বিরোধীরা এতে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনেন, অন্যদিকে কান্তবাবু ইচ্ছেমতো খাজনা বাড়াতে থাকেন। এ কারণে প্রজা বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কান্তবাবু সারা জমিদারি জরিপ করতে চান ও জমার পরিমাণ তিন লাখ টাকা ঠিক করেন। অন্যদিকে সেই সময়কার কৃষকনেতা প্রীতম দাসের নেতৃত্বে রায়তরা কোম্পানির কাছে নিচের আরজিটা পেশ করেন:
‘প্রাচীনকাল থেকেই পরগণা বাহারবন্দে আমাদের ভিটেমাটি। আদি কৃষকদের বংশধর হিসেবেই আমরা এ জায়গায় বাস করি।…পূর্বতন জমিদারেরা আমাদের প্রত্যেকের জমির খাজনা “ভিতরওয়ারি” হিসাবে ধার্য করতেন। আমাদের পরিবার বা বাড়ির আওতার জমি খুদকস্তা বলে বিবেচিত হতো। এইভাবে শুকা হাজার সময় বা খারাপ বা পতিত জমির বিচার অনপেক্ষেই আমরা একটা নির্দিষ্ট খাজনা সব সময় দিয়েছি। চাঁদ রায় থেকে রানি ভবানুর সময় অর্থাৎ পরপর পাঁচজন জমিদারের আমলে জমির মাপজোখ হয়নি।’
ফলে বাহারবন্দের (উলিপুর-চিলমারী) রায়তরা প্রতিরোধে নেমে পড়েন। তাঁরা এজমালি জমি জরিপ করতে দিতে রাজি নন। হরগোবিন্দ বকশির নেতৃত্বে একদল কলকাতায় যায় কোম্পানির কাছে ফরিয়াদ নিয়ে। অন্যদিকে কার্তিক মাস থেকেই খাজনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মোহন বকশি নামের সাবেক জমিদারের লোক উসকানি দেন আর মনিরাম হাজরার নেতৃত্বে চার থেকে পাঁচ শ জনগণকে সশস্ত্র করতে থাকেন। তাঁরা বাহারবন্দের কাশিমবাজার থেকে জমিদারের লোকদের পরগণা থেকে বের করে দেন। আর খাজনা প্রদানে ইচ্ছুক রায়তদের ভয় দেখান। ‘—বরোখল রাজ্য সেহি খল তার প্রজা/ খাজনা না দেয় কাখো নাহি মানে রাজা।’
জোড়গাছ ঘাট। এটি আন্তচর ঘাট। একটি ৪০ হাত নৌকা। একবারে যাত্রী পারাপার সম্ভব ১৫০ জনের। ছই না থাকায় গড়ে ৫০ জন যাত্রী পারাপার করে একবারে। ৩০ মিনিটের পথ জোড়গাছ থেকে শাখাহাতী। শ্যালো ইঞ্জিন বড়জোর দেড় লিটার তেল খায়, কিন্তু ভাড়া ৪০ টাকা। অটো বা ভটভটিতে একই পরিমাণ তেলে সর্বোচ্চ ৮ জন যাত্রী নিয়ে আধা ঘণ্টা চললে ভাড়া নেয় ২০ টাকা। এই অনুপাতে নৌকা ভাড়া হয় জনপ্রতি আড়াই টাকা। তাহলে ৪০ টাকা ভাড়া কেন? বাড়তি সাড়ে ৩৬ টাকা হচ্ছে ঘাট খাজনা, তাহলে রক্তে পাওয়া বাংলাদেশের জন্য যাত্রীদের দায়?
২.
একটা ৪০ টাকার বাঁশ বেচাইলেও ৮ টেকা খাজনা দেওয়া লাগে। নগদ চালু হৈছে ঘাট খাজনা। রৌমারীর জাফরগঞ্জের উমেদ আলী (৫০) ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরগঞ্জের লালচামার একজন। খাজনায় অস্থির চরাঞ্চলের লাখো বাসিন্দা। প্রতিবার উপজেলা ভোট আসে, আসে জোড়গাছ হাটের খাজনার জুলুম নিরসনের প্রতিশ্রুতি। আর দিনের পর দিন খাজনার হার বাড়তেই থাকে।
ফিরছিলাম গরুর হাটি হয়ে। সেখানে কয়েকজন গরু ক্রেতার কাছ থেকে খাজনার রসিদের ফটো ও ক্রেতার ভিডিও রেকর্ড নিই। দেখে ফেলেন ইজারাদারের লোক। জোর করে ভিডিও ও ফটো মুঠোফোন থেকে মুছে দেন। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে ফিরতি একটি গরুবাহী ভটভটিকে আটকাই। গরুর পাইকার উলিপুর ধামশ্রেণির ব্যাপারী আবুল কাশেম (৬৫) ও উলিপুর সদরের আমিনুল(৫০)। তাঁরা খাজনার রসিদ দেখান। রসিদে গরুর মূল্য লেখা ৫০ হাজার, কিন্তু খাজনার ঘর ফাঁকা। তাঁরা জানান, বিক্রেতার কাছে খাজনা নিয়েছে ৩ শ টাকা ও তাঁদের কাছে ৪ শ টাকা।
পরে রসিদের ছবি ফেসবুকে দিলে পোস্টে কড়াই বরিশাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সাদাকাত হোসেন (৪৫) জানান, ‘উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর হাট জোড়গাছের এখন সুনামের পরিবর্তে দুর্নামে ভরপুর।’ স্বপ্নিল নামের একজন লিখেছেন, ‘যারা বলবে, তাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছে।’ হাসান আল নাহিদ লিখেছেন, ‘এরা সংখ্যায় বেশি, যা জুলুম করে তা–ই মানতে বাধ্য হয়।’ ফেরদৌস ওয়াহিদ লিখেছেন, ‘মগের মুল্লুক দেখি নাই, হয়তো এটাই মগের মুল্লুক।’ এ রকম প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন ক্ষোভ জানিয়েছেন পোস্টটিতে। চিলমারী উপজেলার জনবান্ধব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুর রহমান পরের বুধবার হাটে মোবাইল কোর্ট বসান। কিন্তু জনবলসংকটের কারণে তা কতটুকু সম্ভব?
জোড়গাছ ঘাট। এটি আন্তচর ঘাট। একটি ৪০ হাত নৌকা। একবারে যাত্রী পারাপার সম্ভব ১৫০ জনের। ছই না থাকায় গড়ে ৫০ জন যাত্রী পারাপার করে একবারে। ৩০ মিনিটের পথ জোড়গাছ থেকে শাখাহাতী। শ্যালো ইঞ্জিন বড়জোর দেড় লিটার তেল খায়, কিন্তু ভাড়া ৪০ টাকা। অটো বা ভটভটিতে একই পরিমাণ তেলে সর্বোচ্চ ৮ জন যাত্রী নিয়ে আধা ঘণ্টা চললে ভাড়া নেয় ২০ টাকা। এই অনুপাতে নৌকা ভাড়া হয় জনপ্রতি আড়াই টাকা। তাহলে ৪০ টাকা ভাড়া কেন? বাড়তি সাড়ে ৩৬ টাকা হচ্ছে ঘাট খাজনা, তাহলে রক্তে পাওয়া বাংলাদেশের জন্য যাত্রীদের দায়?
কুড়িগ্রামের শাপলা থেকে অটো বা জে এস মাহিন্দ্রা ছাড়ার সময় একবার। তারপর জজ কোর্টের মোড়ে টোল আদায় করে অটো, জে এস কমিটি ও পৌরসভা। তারপর মৎস্য ভবনের সামনে যাত্রীদের কাছে পণ্যের জন্য টোল দিতে হয় পৌরসভাকে। তারপর উলিপুরে পুরোনো বাসস্ট্যান্ড মোড়ে ও গুনাইগাছ মোড়ে, চিলমারীর মাটিকাটা মোড়ে ও বন্দরে। মোট ৮০-৯০ টাকা গাড়িপ্রতি। একই অবস্থা ঘোষপাড়া থেকে ভূরুঙ্গামারী এবং খলিলগঞ্জ থেকে রাজারহাট হয়ে তিস্তা পর্যন্ত।
এই আদায় শুরু করে প্রথম উলিপুর পৌরসভা। আজ থেকে ১৫ বছর আগে। গত পৌরসভা নির্বাচনের সময় বর্তমান মেয়র অটোরিকশার ভাড়া মওকুফের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচন শেষে যথারীতি ভুলে গেছেন। জেলার মোড়ে মোড়ে একেকটা অটো ও জে এসের আলাদা কমিটি। রাজশাহী থেকে নিবন্ধন নম্বর জোগাড় করে আনলেই হলো। তারপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
৩.
গ্রাম ও কৃষি মরে গেল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিরস্থায়ী জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হলো জমির পাশাপাশি হাট ও ঘাট। বছর বছর দুর্ভিক্ষ লেগে থাকল। খাদ্য উদ্বৃত্তের বাংলা হলো চির দুর্ভিক্ষের দেশ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে চিরস্থায়ী দুর্ভিক্ষ। বর্তমান চিলমারী ওয়ারি এলাকার কৃষকেরা গোপীচন্দ্রের গানে গেয়ে উঠেছিলেন: ‘লাঙল বেচায় জোয়াল বেচায় আরও বেচায় ফাল/ খাজনার তাপত বেচায় দুধের ছাওয়াল।’
ভারতবর্ষে প্রথম ভূমি থেকে জমিদারি উচ্ছেদ হয় এই পূর্ব বাংলাতেই। এ দেশের কৃষক-প্রজা পার্টি ও পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এই দাবিতেই। নদীমাতৃক দেশে নৌকা যে ঘাটে ভিড়ে আর কৃষকেরা ধান-পাট বেচে যে হাটে, সেখানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইজাদারি আইন কেমনে বহাল থাকে? নাকি স্বাধীন বাংলাদেশ এখনো কোম্পানিগুলো চালায়?
- নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক।
[email protected]